রায়হান আলী: পবিত্র রমজানকে ঘিরে অসাধু ব্যবসায়ীরা আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। রমজান এলেই যেন নিত্যপণ্যের দাম হয় আকাশছোঁয়া। ক্রয়ক্ষমতার নাগালের বাইরে রয়েছে নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি। বৈশ্বিক নানাপ্রকার প্রভাব আর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। নিত্যপণ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সংসার চালাতে নিম্ন আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। এসব অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার পেছনে অনেক কারণ দাঁড় করিয়েছেন বিশ্লেষকরা। কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলোÑবৈশ্বিকভাবে করোনার তাণ্ডবে স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হওয়া, করোনা পরিস্থিতিতে অসংখ্য কর্মজীবী মানুষের কর্মহীন হওয়া, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতি, বিরূপ আবহাওয়ার কারণে কৃষিক্ষেত্রে ফলন কম হওয়া, দেশের তৈরি পোশাক খাতে বিদেশি বায়ারদের অর্ডারের স্বল্পতা প্রভৃতি।
বর্তমানে গ্রাম-শহরে ভিক্ষুকের সংখ্যা কতটা বেড়ে গেছে, তা বলা বাহুল্য। রাজধানীর রাস্তাঘাটে শুধু ভিক্ষুক আর ভিক্ষুক। রাজধানীসহ সারাদেশের রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল, এয়ারপোর্ট, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজের সামনে, মাজার, বাসাবাড়ি, রাস্তাঘাট এমনকি পাবলিক প্লেসসহ সর্বত্রই ভিক্ষুকদের ভিক্ষা করার দৃশ্য খুবই দুঃখজনক। কত রকমের ভিক্ষুক যে ঢাকা শহরসহ সারাদেশে আছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান কারও জানা নেই। এমনটা আগেও ছিল, তবে সংখ্যাটা মনে হয় অনেকগুণ বেড়েই গেছে। দেশে নিম্ন আয়ের মানুষজন যে কত বিপদে আছে, তা সহজেই অনুমেয়। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, জনগণের মধ্যে একটা নীরব দুর্ভিক্ষ চলমান। ঢাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে সরকার। প্রথম পর্যায়ে ঢাকার সাতটি এলাকায় এই অভিযান পরিচালানা করা হয়। এরপর পুরো রাজধানীকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তা শুধুই কাগজে-কলমে। বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, কূটনৈতিক এলাকায় ভিক্ষাবৃত্তি এবং সামগ্রিকভাবে রাজধানীকে শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তিমুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সরকারি পর্যায়ে যেভাবে সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অনেকের।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, ২০১০ সালে দেশে দারিদ্র নিরসনে সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন ও ভিক্ষাবৃত্তির মতো অমর্যাদাকর পেশা থেকে নিবৃত্ত করার লক্ষ্যে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর আবাসন, ভরণ-পোষণ এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য সরকারের রাজস্ব খাতের অর্থায়নে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান কর্মসূচি নেয়া হয়। ঢাকা মহানগরের ১০টি জোনে ১০টি এনজিওর মাধ্যমে ২০১১ সালে ১০ হাজার ভিক্ষুকের ওপর জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। জরিপকৃত ভিক্ষুকদের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে একটি ডেটাবেইজ তৈরি করা হয়। জরিপে প্রাপ্ত ১০ হাজার ভিক্ষুক থেকে দুই হাজার ভিক্ষুককে নিজ নিজ জেলায় পুনর্বাসনের জন্য নির্বাচিত করা হয়। দেশব্যাপী প্রসারের আগে পদ্ধতিগত কার্যকারিতা নির্ভুল করার লক্ষ্যে এরই মধ্যে ময়মনসিংহ ও জামালপুর জেলায় ৬৬ ভিক্ষুককে রিকশা, ভ্যান ও ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনার জন্য পুঁজি প্রদানের মাধ্যমে পুনর্বাসনের জন্য পাইলট কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
২০২৩ সালে বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছিল বিশ্বব্যাংক। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছিল, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক না হলে দুর্ভিক্ষও দেখা দিতে পারে। এছাড়া অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে ২০২৩ সালের সম্ভাব্য খাদ্যঘাটতির আশঙ্কায় নানা ধরনের সতর্কবার্তা দিয়ে রাখা হয়েছে। বিশ্বের ৮২টি দেশের অন্তত ৩৪ কোটি ৫০ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের খাদ্য নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান ডেভিড বিসলি। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের সাধারণ মানুষ নানা সমস্যায় ভুগছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় এর প্রভাব পড়ছে। সারা বিশ্ব তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটে ভুগছে। বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী, মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। সর্বত্রই যেন একটা মন্দা ভাব ও সংকটপূর্ণ সময় বিশ্বের সঙ্গে আমরাও অতিবাহিত করছি। পণ্যদ্রব্যের দাম যে হারে বেড়েছে, সে হারে শ্রমের মূল্য বাড়েনি। যে হারে বাসাভাড়াসহ সার্বিক ব্যয়ভার আমাদের কাঁধের ওপর চেপে বসেছে, সে হারে আমাদের আয়ের পরিমাণ বাড়েনি। তাই আগের স্বাভাবিক জীবনে আমাদের একটা হতাশা নেমে এসেছে। সবাই আয়-ব্যয়ের সমান্তরাল ঠিক করতে নানাভাবে জীবন-জীবিকার ব্যয়ভার কমানোর চেষ্টা করছি। মানুষ মৌলিক চাহিদা মেটার পর অবশিষ্ট অর্থ থাকলে একটু স্বস্তির চিন্তা করে। মৌলিক চাহিদার সবচেয়ে অন্যতম হলো মানুষের পেটে ভাত দরকার। আমাদের দেশ কৃষিনির্ভর দেশ। আমরা কৃষির ওপর নির্ভর করে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সব সময় চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।
খাদ্যঘাটতি পরিস্থিতি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সবাইকে অনুরোধ করব, কারও কোনো এলাকায় এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। কারণ সারা বিশ্বে এখন যে অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি হয়েছে, আমি যখন জাতিসংঘে গিয়েছি সে বিষয়ে অনেক দেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। সবাই খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত যে, ২০২৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। আরও ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমি বলব, আমাদের দেশের মানুষকে এখন থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।’
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এরই মধ্যে সতর্ক করে বলেছে, ২০২৩ সালে বিশ্বের ৪৫টি দেশে তীব্র খাদ্যঘাটতি দেখা দিতে পারে এবং ২০ কোটি মানুষের জন্য জরুরি সহায্য তার প্রয়োজন হতে পারে।
গত বছরের অক্টোবরে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রতিবেদনে আইএমএফ বলেছে, ২০২৩ সালে একটি মারাত্মক মন্দার মুখোমুখি হতে পারে বিশ্ব অর্থনীতি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নেমে যেতে পারে ২ দশমিক ৭ শতাংশে।
সোনার বাংলার মানুষের সোনার মতো হাসিমাখা মুখ দেখতে সবার একযোগে অর্থনীতির চাকা সচল করতে কাজ করতে হবে। খাদ্যের ঘাটতি পূরণে আমাদের আতঙ্কিত না হয়ে কৃষি খাতকে যুগোপযোগী আধুনিকায়ন করতে হবে। বিশ্বের সঙ্গে আমরাও এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সঠিক পরিকল্পনা করে সামনে এগিয়ে যেতে চাই। বিশ্ব খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্বনেতারা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশনেত্রীও সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় শুধু সরকারের ওপর দায় চাপিয়ে আমাদের বসে থাকলে চলবে না। জীবনযাপনে আমাদের মিতব্যয়ী হতে হবে, অপচয় রোধ করতে হবে। সরকারি উদ্যোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগকে আরও বেগবান করতে হবে। দেশের কৃষি খাতকে কীভাবে আরও চাঙা করা যায়, তার সমন্বিত পরিকল্পনা করতে হবে। কৃষকের মুখের হাসি কীভাবে ফোটানো যায়, সেজন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। দেশের যত অর্থনৈতিক জোন আছে, সেগুলোর গতিশীলতা ত্বরান্বিত করতে হবে। দেশে শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। নিম্ন আয়ের মানুষজনের বহুমাত্রিক সমস্যা নিরসনে সবাইকে উদ্যোগী ও সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে রমজানে দ্রব্যমূল্য সাধারণ জনগণের ক্রয়ক্ষমতার নাগালে রাখতে সর্বাত্মক পদক্ষেপ দরকার।
আইনজীবী, জজ কোর্ট, খুলনা