প্রতিনিধি, রাজশাহী: রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমানকে ওএসডি করাসহ ১৫ কর্মকর্তার পদোন্নতিকে অবৈধ ঘোষণা করে স্থগিত করা হয়েছে। গত ২০ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব চৌধুরী সামিয়া ইয়াসমিন স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে চেয়ারম্যানকে ওএসডি এবং গত ৫ মার্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব আক্তার উননেছা শিউলী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে প্রথমে ছয়জন এবং পরে ১৯ মার্চ আরও ৯ জনের পদোন্নতি স্থগিত করা হয়। একই সঙ্গে অবৈধভাবে পদোন্নতি পাওয়া কর্তাদের উত্তোলিত অতিরিক্ত অর্থ ফেরত দেয়ার নির্দেশও দেয়া হয়। গত ২০ মার্চ এ চিঠি পেয়েছেন রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সচিব।
বোর্ড চেয়ারম্যানের ওএসডি’র ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, অবসর বা পিআরএলে গমনের সুবিধার্থে বোর্ড থেকে প্রেষণ প্রত্যাহার করে তাকে ওএসডি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর রাজশাহী বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে প্রেষণে পদায়ন পান অধ্যাপক মো. হাবিবুর রহমান। তিনি এর আগে একই বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। রাজশাহী মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পেয়ে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় মো. হাবিবুর রহমানকে প্রেষণে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক পদে নিয়োগ দিয়েছিল।
এদিকে রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের ১৫ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছিল অবৈধভাবে। তার আগে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের এক তদন্তে রাজশাহী বোর্ডের ১৫ কর্মকর্তার পদোন্নতিতে গুরুতর অসংগতির অভিযোগ উঠে আসে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) আলাদা দুই চিঠি দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ২৩ থেকে ২৫ নভেম্বর পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে গিয়ে সরেজমিনে অভিযোগ তদন্ত করেছেন।
তদন্ত কমিটিতে ছিলেন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক অলিউল্লাহ মো. আজমতগীর, শিক্ষা পরিদর্শক আজিজুর রহমান, মনকিউল হাসনাত, হেমায়েত উদ্দীন এবং অডিট কর্মকর্তা চন্দন কুমার দেব।
গত বছরের জানুয়ারিতে কমিটি দুদক ও মাউশিতে এ প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে এ ১৫ কর্মকর্তার পদোন্নতি স্থগিত এবং গ্রহণ করা অতিরিক্ত অর্থ ফেরত নেয়ার সুপারিশ করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার পরে পদোন্নতি স্থগিত ও গ্রহণ করা অতিরিক্ত অর্থ ফেরত নেয়ার সিদ্ধান্ত দেয়া হয়।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সাবেক দুই চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ ও অধ্যাপক ড. মোকবুল হোসেনের কার্যকালে পদোন্নতির এসব অনিয়ম ঘটে। দুই দফায় ১৫ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিতে নানা অনিয়ম করেন তারা। বোর্ডের সিলেকশন কমিটিও নিয়ম না মেনে তাদের পদোন্নতির সুপারিশ করেছিল বলে তদন্তে উঠে আসে।
২০১৭ সালে প্রথমে ৯ জন সপ্তম থেকে ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি পান। তারা হলেন, উপ-কলেজ পরিদর্শক নেসার উদ্দিন আহমেদ, উপ-বিদ্যালয় পরিদর্শক মানিক চন্দ্র সেন, সাবেক উপ-সচিব (প্রশাসন) ওয়ালিদ হোসেন, উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (সনদ ও রেকর্ডস) মঞ্জুর রহমান খান, ক্রীড়া কর্মকর্তা লিটন সরকার, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম, অডিট কর্মকর্তা সেলিনা পারভীন, উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (মাধ্যমিক) জাহিদুর রহমান ও উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (উমা) হোসনে আরা আরজু।
তাদের পদোন্নতি দিতে সিলেকশন কমিটি ২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল শুক্রবার বোর্ডের চেয়ারম্যানের কক্ষে ৪৮ উপযুক্ত কর্মকর্তার মৌখিক পরীক্ষা নেয়। কমিটির সভাপতি ছিলেন বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ। ৪৮ জনের মধ্যে কমিটি ৯ জনকে পদোন্নতির সুপারিশ করলে ২০১৭ সালের ৯ জুলাই তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়।
কর্মকর্তাদের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি দেয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হয়নি। শুধু মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে ৯ জনের পদোন্নতির তালিকাটি চূড়ান্ত করা হয়। ওই মেধাতালিকা থেকে ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান মোকবুল হোসেন আরও ছয়জনকে পঞ্চম গ্রেডে পদোন্নতি দেন বিধি লঙ্ঘন করে। তারা হলেনÑউপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (জেএসসি) ফরিদ হাসান, উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (স্ক্রিপ্ট) রুবী, উপ-সচিব (ভান্ডার) দুরুল হোদা, উপ-সচিব (প্রটোকল) খোরশেদ আলম, উপ-বিদ্যালয় পরিদর্শক (রেজি) মো. নুরুজ্জামান ও লাইব্রেরি অ্যান্ড ইনফরমেশন ডকুমেন্টেশন কর্মকর্তা সুলতানা শারমিন আক্তার। প্রথমে বিতর্কিত ওই মেধাতালিকা থেকে ১ থেকে ৯ নম্বর ক্রমিকের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেয়া হলেও দ্বিতীয় পদোন্নতির ক্ষেত্রে এ ক্রমিকও অনুসরণ করা হয়নি। দ্বিতীয় দফায় পদোন্নতি দেয়া হয়েছিল ক্রমিকের ১২, ১৩, ২০, ২১, ২৫ ও ৩৮ নম্বরে থাকা কর্মকর্তাকে।
এ ছয়জনের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে শিক্ষা বোর্ডকে বলা হয়েছে, তাদের পদোন্নতির আদেশ স্থগিত করে তার প্রমাণ মন্ত্রণালয়ের এ বিভাগে পাঠাতে হবে। পদোন্নতি পাওয়ার পরে এ কর্মকর্তারা পঞ্চম গ্রেডে বেতন গ্রহণ করে থাকলে গৃহীত অতিরিক্ত অর্থ তাদের কাছ থেকে আদায় করে শিক্ষা বোর্ডের কোষাগারে জমা করতে হবে।
রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সচিব মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনিক যে পদক্ষেপ নেয়া হয়, সেটা আমরা গ্রহণ করব। সরকারি নির্দেশ কার্যক্রমে কোনো অবহেলার সুযোগ নেই বলে জানান তিনি।