রহমত রহমান: পার্বত্য চট্টগ্রামের মহকুমা শহর খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলা। ঐতিহাসিক রামগড় বহু বছর কিছুটা আড়ালে থাকলেও কয়েক বছর ধরে খাগড়াছড়িসহ দেশের মানুষের নজরে রয়েছে, কারণ সেখানে নির্মিত হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত যোগাযোগ ক্ষেত্র রামগড় স্থলবন্দর। দুই দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে বন্দরটি সম্ভাবনাময় হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সেপ্টেম্বর মাসে এ বন্দর চালু হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু চালু হওয়ার জন্য প্রস্তুত করা যায়নি। তবে এ বন্দর ও শুল্ক স্টেশন চালু করার ক্ষেত্রে ছয়টি সমস্যা সামনে এসেছে। চট্টগ্রাম ভ্যাটের কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে সেই ছয়টি সমস্যা উঠে এসেছে। সম্প্রতি এনবিআরে সেই প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
এনবিআর সূত্রমতে, রামগড় স্থলবন্দরকে কার্যকর করার লক্ষ্যে পরিদর্শন করে সমস্যা চিহ্নিত করে মতামত-সংবলিত প্রতিবেদন দিতে ১৪ আগস্ট বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ এনবিআরকে চিঠি দেয়। চিঠিতে রামগড় শুল্ক স্টেশনের সীমানা নির্ধারণ, আমদানি-রপ্তানির পণ্য ওঠানো ও নামানোর নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ, সীমানাভুক্ত স্থানকে পাবলিক ওয়্যারহাউজিং স্টেশন এবং স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষকে পাবলিক ওয়্যারহাউস কিপার ঘোষণা করতে রামগড় স্থলবন্দর পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। চিঠি অনুযায়ী কমিটি গঠন করে পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দিতে চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেটকে নির্দেশ দেয় এনবিআর। নির্দেশ অনুযায়ী গঠিত কমিটি পরিদর্শন শেষে ১৫ নভেম্বর প্রতিবেদন দিয়েছে। সরেজমিনে পরিদর্শনে কমিটি ছয়টি সমস্যা পেয়েছে। ছয়টি সমস্যা স্থলবন্দর ও বন্দরসংশ্লিষ্ট এলসি স্টেশন-সংক্রান্ত। প্রতিবেদনে ছয়টি সমস্যার বিষয় তুলে ধরে তা নিরসনে প্রস্তাব ও মতামত দেয়া হয়, যার মধ্যে প্রথম হলো সড়কের সমস্যা। প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে রোডের বারৈয়ারহাট থেকে রামগড় স্থলবন্দর পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি পণ্যবাহী ট্রাক বা ট্রেইলার চলাচলের জন্য প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সংকীর্ণ। ভারী যানবাহন চলাচলের সক্ষমতাসম্পন্ন নয়। এই রাস্তাটির পুনর্নিমাণ বা সংস্কার কাজ চলমান রয়েছে। দ্বিতীয় সমস্যাটি হলো ব্রিজ সমস্যা। প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বারৈয়ারহাট থেকে রামগড় পর্যন্ত সড়কে সাতটি পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজের মধ্য থেকে পাঁচটি ব্রিজের সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু দুটি ব্রিজের কাজ শেষ হয়নি। তৃতীয় সমস্যা হলো বাংলাদেশ অংশে বিভিন্ন অফিসের কাজ শেষ হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ অংশে স্থলবন্দর-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অফিসের অবকাঠামোগত নির্মাণকাজ এখনো শেষ হয়নি।
চতুর্থত, রামগড় স্থলবন্দরে এলসি স্টেশনের কাজ হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় পণ্য পরিবহনের জন্য অদূর ভবিষ্যতে রামগড় স্থলবন্দর বা এলসি স্টেশনের ভৌগোলিক ও কৌশলগত গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে এই বন্দর বা শুল্ক স্টেশনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। এই বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে রামগড় স্থল কাস্টমস স্টেশনটি ভ্যাট চট্টগ্রামের সাংগঠনিক কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেখানে একজন যুগ্ম কমিশনার, একজন উপ-কমিশনার, দুজন সহকারী কমিশনারসহ মোট ৬৩ জন, যানবাহন ও অফিস সরঞ্জাম অন্তর্ভুক্তকরণের অনুরোধ জানিয়ে সম্প্রতি এনবিআরকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এই স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ভবিষ্যতে বৃদ্ধি পেলে রামগড় স্থল শুল্ক স্টেশনটি সার্বক্ষণিকভাবে ২৪ ঘণ্টা শুল্ক বিভাগের জনবল নিয়োজিত থাকবে। এই বন্দর ও শুল্ক স্টেশন ভারতীয় সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় এখানে পদায়ন করা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ভবিষ্যতে আবাসিক সমস্যার সৃষ্টি হবে। সেজন্য আবাসিক ব্যবস্থা ও শুল্ক গুদাম নির্মাণের জন্য ৫ দশমিক ৭৩ একর জমি অধিগ্রহণে ৯৪ কোটি ৫৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ চেয়ে এনবিআরকে চিঠি দেয়া হয়েছে।
ষষ্ঠ সমস্যা হলো, পণ্য ওঠা-নামার মাঠ তৈরি হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিটির পরিদর্শনে স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানি পণ্য ওঠানো বা নামানোর জন্য নির্ধারিত স্থানটিতে উš§ুক্ত কৃষিজমি দেখতে পাওয়া যায়, যা পণ্যবাহী ট্রাক বা ট্রেইলারের পণ্য ওঠানো বা নামানোর জন্য কোনোভাবেই উপযোগী নয় বলে মনে করেন কমিটির সদস্যরা। নির্ধারিত স্থানে ভারী পণ্য ওঠানো বা নামানোর জন্য উপযোগী করার লক্ষ্যে কোনো কার্যক্রম পরিদর্শনকালে পরিলক্ষিত হয়নি। অর্থাৎ রামগড় স্থলবন্দরটি আমদানি-রপ্তানি পণ্য ওঠানো বা নামানোর জন্য এখন পর্যন্ত সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি এবং এ স্বল্প সময়ের মধ্যে এই ধরনের সক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব নয়। তবে আন্তর্জাতিক আগমন ও বহিরাগমন যাত্রীরা এবং যাত্রীদের সঙ্গে আনা ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং করা তথা ইমিগ্রেশন ও যাত্রী ব্যাগেজের শুল্ক আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মিত হয়েছে।
প্রতিবেদনে রামগড় স্থলবন্দরের সম্ভাবনা তুলে ধরে বলা হয়, স্থলবন্দরটির কার্র্যক্রম সম্পূর্ণভাবে চালু হলে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় বাংলাদেশের বিভিন্ন উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী ও খাদ্যদ্রব্য যেমন রপ্তানি হবে, তেমনি বাংলাদেশেও এই রাজ্যগুলো থেকে প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী অতি দ্রুত আমদানি করা সম্ভব হবে। এতে উভয় দেশেরই পাহাড়ি বা পার্বত্য এলাকার উন্নয়ন, সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। স্থলবন্দরের কাজ দ্রুত শেষ করে বন্দর ও শুল্ক স্টেশনের কার্যক্রম শুরু করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করা হয়। একইসঙ্গে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের প্রস্তাব অনুযায়ী বর্তমানে যাত্রীদের ব্যাগেজ-সংক্রান্ত শুল্ক আনুষ্ঠানিকতা সম্পাদনের জন্য শুল্ক স্টেশনের সীমানা নির্ধারণ, পণ্য ওঠা-নামার নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ, সীমানাভুক্ত স্থানকে পাবলিক ওয়্যারহাউজিং স্টেশন ও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষকে পাবলিক ওয়্যারহাউস কিপার ঘোষণার মতামত ও প্রস্তাব করা হয় প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, রামগড় স্থলবন্দর খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলা সদর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে ফেনী নদীর তীরে অবস্থিত। নদীর প্রস্থ আনুমানিক ৩২০ ফুট। এ স্থলবন্দরের উত্তর দিকে ফেনী নদী, দক্ষিণে রামগড় রোড, পশ্চিমে ফেনী নদীর কুল এবং পূর্বে রামগড় থানা রয়েছে। উত্তর দিকে ফেনী নদীর অপর পাড়ে ভারতীয় স্থলবন্দর সাবরুম রয়েছে। বন্দরের জন্য ১০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, যার ওপর বর্তমানে ১২ হাজার বর্গফুট আয়তনের বন্দর শেড নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে, যা দ্রুত শেষ হবে। এই শেডে বর্তমানে শুধু যাত্রী গমনাগমন কার্যক্রম চালু হবে। বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ এ শেড নির্মাণ করছে। এই শেডে যাত্রী ব্যাগেজ-সম্পর্কিত শুল্ক আনুষ্ঠানিকতার জন্য ১৩০০ বর্গফুট জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে রোডের বারৈয়ারহাট থেকে করেরহাট রোড হয়ে রামগড় উপজেলা বাজারের নিকটবর্তী স্থানে এই স্থলবন্দর বা এলসি স্টেশন পর্যন্ত যানবাহন চলাচলের উপযোগী পাকা রাস্তার দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। এই সড়কের ওপর সাতটি ব্রিজ রয়েছে। এছাড়া ফেনী নদীর ওপর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যাতায়াতের জন্য ব্রিজ নির্মাণ এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
রামগড়ের বিপরীত পাশে ভারতীয় এলসি স্টেশনের অবস্থা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, রামগড় স্থল বন্দরের বিপরীতে ফেনী নদীর অপর পাড়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুম এলসি স্টেশন রয়েছে। এই স্টেশনের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবকাঠামো উন্নত। এছাড়া বিভিন্ন অফিস ভবনের জন্য অবকাঠামো নির্মাণের কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
চট্টগ্রাম ভ্যাটের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে জানিয়েছেন, বন্দর প্রস্তুত না হওয়ায় উদ্বোধন হয়নি। তবে শুধু যাত্রী গমনাগমনের জন্য প্রস্তুত হতেও আরও দু’মাস লাগতে পারে।