নিজস্ব প্রতিবেদক : বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎ খাতে সরকারকে যে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে তার মূলে রয়েছে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও ত্রুটিপূর্ণ বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তিগুলো। পাশাপাশি ২০১০ সালে প্রণীত ও ২০২১ সালে সংশোধিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের ক্ষমতাবলে সরকার অপচয়কে উৎসাহিত করছে এবং এর ফলে একশ্রেণির কোম্পানি অতি মুনাফা লুটে নিচ্ছে বলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
তারা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতে অদক্ষতা ও অনিয়মের কারণে এ খাতে সরকারের বিপুল পরিমাণ ভর্তুকির দায় মেটাতে হচ্ছে জনগণকেই। বর্তমানে আইনটির প্রয়োজন নেই উল্লেখ করে দ্রুত আইনটি বাতিল করার দাবিও জানায় সিপিডি। একই সঙ্গে সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যেসব নীতিমালা ও বিধিবিধান প্রণয়ন করেছে সেগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই বলে সংগঠনটি উল্লেখ করে।
রাজধানীর ধানমন্ডিতে প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব কার্যালয়ে গতকাল আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। ‘নতুন নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০২২ (খসড়া): এটি কি পরিচ্ছন্ন জ্বালানির লক্ষ্য পূরণ করতে সক্ষম হবে?’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন করে সিপিডি। এতে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির গবেষণা সহযোগী হেলেন মাশিয়াত প্রিয়তী ও মাসফিক আহসান হƒদয়।
সংবাদ সšে§লনে সিপিডির এ গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি সমন্বয় নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফের) সঙ্গে কাজ করছে সরকার। এই খাতের ভর্তুকির সমন্বয় করা হচ্ছে ভোক্তার ওপর দায় চাপিয়ে। দ্রুত জ্বালানি সরবরাহ আইনের কারণে বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে, বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এখানে জবাবদিহিতার কোনো সুযোগ থাকছে না। ফলে ভর্তুকির দায় ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দিয়ে ভর্তুকি সমন্বয় করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আইনটি যদি অবলোপন করা হয় এবং সেই অনুযায়ী সব চুক্তির সংশোধনী আনা হয়, তাহলে অনেক অর্থের সাশ্রয় হবে। যা দিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উন্নয়নে বিনিয়োগ করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর দক্ষতা নিশ্চিতে ‘নো ইলেকট্রিসিটি, নো পে’ ব্যবস্থা চালু করতে হবে।’ বর্তমানে বিদ্যুৎ সরবরাহ না করেও ক্যাপাসিটি চার্য তুলে নেয়ার সুযোগ রয়েছে। এ সুযোগ থাকা কোনোভাবেই উচিত নয় বলে মনে করে সিপিডি। সংগঠনটি জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে এসে ধীরে ধীরে নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে অগ্রসর হওয়ার পরামর্শ দেয়।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিদ্যুতের বড় ঘাটতি মেটাতে ২০১০ সালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনের প্রয়োজন ছিল, তবে বর্তমানে আইনটি অদক্ষতার জায়গা তৈরি করছে। ওই সময়ে দেশে বড় রকমের বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল, সেটা মেটানোর জন্য চুক্তির দরকার ছিল। এরপর চারবার আইনটি সংশোধন করে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। আমরা মনে করি, এখন যে জায়গায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি, এরকম চুক্তির আর প্রয়োজন নেই। তিনি আরও বলেন, এই আইন থেকে সরকারের সরে আসা দরকার। এ আইন বিভিন্নভাবে সমস্যা করছে। সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি নিয়ে যেসব চুক্তি হয়েছে বা এর আগেও যেগুলো হয়েছেÑসেগুলো এখন সরকারের জন্য বড় রকমের মাথাব্যথার কারণ। আমরা মনে করি, অনতিবিলম্বে এই আইন অবলোপন এবং তা থেকে সরে আসা দরকার।
এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘আইনটি না থাকলেও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে কোনো চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হবে না। আমরা শুনে এসেছি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের মূল্য সবচেয়ে কম। অথচ নতুন চুক্তির অধীনে আমরা যে ভারত থেকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ আনা শুরু করলাম, সেটার মূল্য তো ১৫ টাকা। এটা তো বোধগম্য না কী করে এত বেশি দামে বিদ্যুৎ ক্রয় হতে পারে? জ্বালানি চুক্তি খোলামেলা হওয়া উচিত জানিয়ে তিনি বলেন, কোনো চুক্তির ডকুমেন্টস আমরা পাই না। কী রেটে চুক্তিগুলো করা হচ্ছেÑজনগণের সেটা জানার অধিকার রয়েছে।’
এ সময় নতুন নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০২২-এর খুঁটিনাটি তুলে ধরে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘এতে জ্বালানি নিরাপত্তার পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যেসব চুক্তি হচ্ছে, সেগুলো কতটা স্বচ্ছতা ও দক্ষতার সঙ্গে করা হচ্ছে তা আলোচনা হয়েছে। সরকারের রাজনৈতিক লক্ষ্য ২০৪১ সালের ভেতর ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি আহরণ, তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু সেসব বাস্তবায়নে পর্যায়ে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘সরকার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এছাড়া বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের একটি সমন্বিত মাস্টার প্ল্যান রয়েছে। নতুন করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য নীতিমালা করা হচ্ছে। কিন্তু এসব নীতিমালার মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। সরকারের একেক দলিলে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিষয়ে একেক ধরেনের লক্ষ্যমাত্রা দেখানো হয়েছে। এটি বিভ্রান্তিকর। এ থেকে বের হয়ে আসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে একটি সমন্বয় সেল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নীতিমালাগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা আবশ্যক।’
বিদ্যুৎ জ্বালানির দাম বৃদ্ধির বিষয়ে সম্প্রতি সরকার আইনে যে সংস্কার এনেছে তার সমালোচনা করে সিপিডি উল্লেখ করে, এখন থেকে সরকার জরুরি প্রয়োজনে কোনো ধরনের শুনানি ছাড়াই বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়াতে পারবে। এর ফলে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। এটি দুর্ভাগ্যজনক। আইএমএফের শর্ত পরিপালনের লক্ষ্যে বিদ্যুৎ-জ্বালানির দর সমন্বয়ের অংশ হিসেবে সরকার এটি করেছে বলে মনে করে সিপিডি। এর ফলে সাধারণ ভোক্তাদের ওপর চাপ বাড়বে এবং এ থেকে প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি।