ইসমাইল আলী: গত জুলাইয়ে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক লোডশেডিং। মাঝে কিছুটা কমলেও সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে তা চরম আকার ধারণ করে। অক্টোবরের শুরুর দিকে লোডশেডিং রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছায়। সে সময় প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। হিসাবমতে, চলতি অর্থবছর শুধু অক্টোবরেই বিদ্যুৎ উৎপাদন গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে কমেছে। বাকি মাসগুলো উৎপাদন বেড়েছে বলেই দেখানো হয়েছে।
যদিও গত নভেম্বরে লোডশেডিংয়ের মাত্রা কমে আসে। ডিসেম্বরের শেষ দিকে না থাকলেও জানুয়ারিতেই তা আবার ফিরে আসে। রেকর্ড লোডশেডিংয়ের পরও চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসের (জুলাই-জানুয়ারি) মধ্যে অক্টোবর ছাড়া বাকি ছয় মাসই বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে বলে দেখানো হয়েছে। তবে লোডশেডিং কেন হচ্ছেÑএর কোনো সঠিক ব্যাখ্যা নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লোডশেডিংয়ের সঠিক তথ্য দেশের কোনো সংস্থার কাছে নেই। বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী বা বিতরণকারী কোনো সংস্থাই লোডশেডিংয়ের সঠিক হিসাব দেখায় না। এমনকি বিদ্যুৎ খাতের বিভিন্ন সংস্থার ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) প্রতিবেদনেও লোডশেডিংয়ের কোনো তথ্য নেই। বরং সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিকেই তুলে ধরা হয়।
বিভিন্ন উৎপাদনকারী কোম্পানি ও সংস্থা থেকে সংগ্রহ করে বিদ্যুৎ পাইকারি (বাল্ক) পর্যায়ে বিতরণকারী সংস্থাগুলোর কাছে পৌঁছে পাওয়ার গ্রিড করপোরেশন অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) লিমিটেড। তবে কোম্পানিটির এমআইএস প্রতিবেদনে লোডশেডিংয়ের কোনো হিসাব নেই। তারা মাসিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সঞ্চালনের হিসাব দেখাচ্ছে। এমনকি সর্বোচ্চ চাহিদা ও উৎপাদনের হিসাবও দেখায় পিজিসিবি। তবে লোডশেডিংয়ের কোনো হিসাব দেখায় না সরকারি এ কোম্পানিটি।
পিজিসিবির তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে নেট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল (আমদানিসহ) চার হাজার ৯৭৬ কোটি ৩৯ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল চার হাজার ৭১৫ কোটি ৯৬ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। অর্থাৎ সাত মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ২৬০ কোটি ৪৩ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বা পাঁচ দশমিক ২৩ শতাংশ। এই মাসের মধ্যে শুধু অক্টোবরে উৎপাদন কমেছিল ৪৪ কোটি ৩২ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বা পাঁচ দশমিক ৮০ শতাংশ।
যদিও চলতি অর্থবছরের ১৯ জুলাই থেকে ঘোষণা দিয়ে এলাকাভিত্তিক আনুষ্ঠানিক লোডশেডিং শুরু করে সরকার। তবে এর আগেই গ্যাস সংকটে অনানুষ্ঠানিক লোডশেডিং শুরু হয়। অথচ ওই মাসে রেকর্ড পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে বলে দেখানো হচ্ছে। এছাড়া আগস্টেও বড় ধরনের লোডশেডিং হয়। অথচ ওই মাসেও রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদনের তথ্য দেখানো হয়েছে।
পিজিসিবি বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে রেকর্ড ৮২৪ কোটি ৪৬ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। গত অর্থবছরের জুলাইয়ে এর পরিমাণ ছিল ৭২৩ কোটি ২৩ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। অর্থাৎ ওই মাসে উৎপাদন বাড়ে ১০১ কোটি ২৩ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বা ১৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের পরের মাসে (আগস্টে) বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেকর্ড হয়। ওই মাসে ৮৪০ কোটি ৯৬ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। গত অর্থবছরের আগস্টে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল ৭৯০ কোটি সাত লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। অর্থাৎ আগস্টে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে ৫০ কোটি ৮৯ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বা ছয় দশমিক ৪৪ শতাংশ।
সেপ্টেম্বরেও ৩০ কোটি ১২ কিলোওয়াট ঘণ্টা বা তিন দশমিক ৮১ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের এ মাসে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ৮১৯ কোটি ৬৪ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। গত অর্থবছরের একই মাসে যা ছিল ৭৮৯ কোটি ৫২ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। অক্টোবরে কমলেও নভেম্বরে বিদ্যুৎ উৎপাদন আবার বেড়ে যায়। ওই মাসে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ৬১৩ কোটি ৭৭ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। গত অর্থবছরের নভেম্বরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৫৫৩ কোটি ৪৪ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছর নভেম্বরে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে ৬০ কোটি ৩৩ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বা ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ।
একইভাবে গত ডিসেম্বরে ৪০ কোটি ৬৪ কিলোওয়াট ঘণ্টা বা সাত দশমিক ৬৫ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বরে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ৫৭১ কোটি ৬৪ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। গত অর্থবছরের একই মাসে যা ছিল ৫৩১ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা। আর জানুয়ারিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে ২১ কোটি ৫৪ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বা তিন দশমিক ৮২ শতাংশ। ওই মাসে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ৫৮৫ কোটি ৬১ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। গত অর্থবছরের জানুয়ারিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৫৬৪ কোটি সাত লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা।
লোডশেডিং বৃদ্ধির পরও উৎপাদন বাড়ার এ হিসাবকে সংশয়পূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ খাতের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতউল্লাহ শেয়ার বিজকে বলেন, দেশে বিদ্যুৎ-জ্বালানির অনেক হিসাব ও তথ্য সংশয়পূর্ণ। দেশে বিদ্যুতের চাহিদা প্রতি বছর কী হারে বাড়ছে তার কোনো সঠিক ডেটাবেজ নেই। আবার উৎপাদন বাড়লেও তা চাহিদার কতটা পূরণ করতে সক্ষম তারও সঠিক কোনো প্রক্ষেপণ নেই। আবার গ্যাস ও তেলের সংকটে বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ গচ্চা দেয়া হচ্ছে। এ খাতে শৃঙ্খলা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে বলে মনে করেন তিনি।
যদিও এ বিষয়ে বিদ্যুৎ খাতের সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, প্রতিদিন দেশে প্রায় ১০০ মেগাওয়াট চাহিদা বাড়ছে। তবে চাহিদা বাড়লেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জ আসবেই। এটিকে মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।