প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

শতভাগের বেশি মুনাফা ১৬ কোম্পানির শেয়ারে!  

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ নিয়াজ মাহমুদ: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ১৬ কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে বছরের ব্যবধানের ১০০ থেকে ৫০০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করেছেন বিনিয়োগকারীরা। বিভিন্ন খাতের এসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করে তারা তুষ্ট থাকলেও মৌলভিত্তির বিচারে পিছিয়ে রয়েছে এসব কোম্পানি। কারণ মৌলভিত্তির বিচারে অন্য কোম্পানির তুলনায় এ তালিকায় থাকা বেশিরভাগ কোম্পানির অবস্থান ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে এবং এসব কোম্পানির ভিত্তি নড়বড়ে। বছরজুড়ে এসব কোম্পানির অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির ছিল না কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ। ফলে এ ধরনের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা লাভের চেয়ে ঝুঁকি বেশি থাকে বলে মন্তব্য করেছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা। ফলে এমন বিনিয়োগের আগে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, এক বছরের ব্যবধানে (বছরের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন হিসাব অনুযায়ী) শতভাগের বেশি দরবৃদ্ধি পাওয়া কোম্পানিগুলো হচ্ছে বঙ্গজ, তাল্লু, মডার্ন ডায়িং, বিডি অটোকারস, শ্যামপুর সুগার, রেনউইক যজ্ঞেশ্বর, ন্যাশনাল টিউবস, বিডি থাই, মেঘনা পিইটি, পেনিনসুলা চিটাগং, ইস্টার্ন লুব্রিক্যান্টস, গোল্ডেন হার্ভেস্ট, রহিম টেক্সটাইল, শাশা ডেনিমস, প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও ন্যাশনাল হাউজিং।

পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগকারীরা সাধারণত দুই মুনাফা পান। এর মধ্যে একটি হচ্ছে লভ্যাংশ থেকে পাওয়া মুনাফা। অন্যটি শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা। তবে এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা লভ্যাংশের বিবেচনা না নিয়ে শেয়ার বিক্রি করে লাভবান হওয়ার প্রচেষ্টা করেছেন।

ডিএসই থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, এসব কোম্পানির মধ্যে এক বছরের ব্যবধানে কিছু কোম্পানির শেয়ারের দর বেড়েছে ২০০ শতাংশের বেশি, যা বিনিয়োগকারীসহ সংশ্লিষ্ট সবার চোখে সন্দেহজনক। বিষয়টি নজর এড়ায়নি ডিএসই ও বিএসইসির। তারা এসব কোম্পানিকে দর বাড়ার কারণ জানতে চেয়ে নোটিস দিয়েছে। তবে কোম্পানিগুলো কোনো সংবেদনশীল দিতে পারেনি। কিন্তু তারপরও এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগে মগ্ন ছিলেন একশ্রেণির বিনিয়োগকারী।

দেখা যায়, এক বছরের ব্যবধানে শ্যামপুর সুগারের প্রতিটি শেয়ারের দর বেড়েছে ৫০৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ। বছরের একপর্যায়ে এ শেয়ারের দর ছিল পাঁচ টাকা ২০ পয়সা। পরে সে দর চলে যায় ৩১ টাকা ৪০ পয়সায়। অথচ দীর্ঘদিন থেকে এ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা নাজুক। একইভাবে ইস্টার্ন লুব্রিক্যান্টসের শেয়ারের দর বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। অন্য কোম্পানি মডার্ন ডায়িংয়ের শেয়ারের দর বেড়েছে ৩৭১ দশমিক ২৩ শতাংশ। বিনিয়োগকারীদের চাহিদার শীর্ষে থাকলেও দীর্ঘদিন থেকে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটির। সন্তোষজনক লভ্যাংশ দিতে না পারায় বর্তমানে কোম্পানিটির অবস্থান ‘বি’ ক্যাটাগরিতে। এছাড়া বিডি অটোকারসের শেয়ারের ৩০৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ, রেনউইক যজ্ঞেশ্বর শেয়ারে বছরের ব্যবধানে ২৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং তাল্লু স্পিনিংয়ের শেয়ারের দর বেড়েছে ২৪১ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

বিষয়টি জানতে যোগাযোগ করা হলে বঙ্গজের কোম্পানি সচিব ফিরোজ ইফতেখার শেয়ার বিজকে বলেন, ‘শেয়ারের দর বাড়ার কোনো কারণ আমাদের জানা নেই। তবে আমরা বিগত বছরগুলোতে শেয়ারহোল্ডারদের ভালো লভ্যাংশ প্রদান করে আসছি। সে কারণে হয়তো বিনিয়োগকারীদের এ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে আগ্রহ থাকতে পারে।’ প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন কমে যাওয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন. ‘আমাদের মেশিনটি পুরোনো হয়ে গেছে। যে কারণে কমে গেছে উৎপাদন। ফলে কমে গেছে আমাদের আয়ও।’

বিনিয়োগকারীদের শতভাগ মুনাফা করা অন্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের ন্যাশনাল হাউজিং ফিন্যান্স ও ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের গত ৫২ সপ্তাহে বা এক বছরে সর্বনিম্ন শেয়ারদর ছিল ২৬ দশমিক ১০ টাকা। এ সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ শেয়ারদর দাঁড়ায় ৬৫ দশমিক ৯০ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের মধ্যে শেয়ারদর বাড়ে ১৫২ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অন্যদিকে ১৯৮৮ সালে তালিকাভুক্ত বিডি অটোকারসের শেয়ারদর বছরে সর্বনিম্ন ছিল ২৫ দশমিক ১০ টাকা। আর সর্বোচ্চ ছিল ১০২ দশমিক ৪০ টাকা। এ সময়ের মধ্যে দর বেড়েছে ৩০৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। কোম্পানিটি বর্তমানে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে লেনদেন করে। বছরের ব্যবধানে প্রকৌশল খাতের রেনউইক যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোম্পানি (বিডি) লিমিটেডের বিনিয়োগকারীদের সর্বোচ্চ মুনাফা হয়েছে ২৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ। গত ৫২ সপ্তাহে সর্বনিম্ন শেয়ারদর ছিল ২৩৫ টাকা। এ সময়ের মধ্যে শেয়ারপ্রতি সর্বোচ্চ দর হয়েছিল ৮৬১ দশমিক ৮০ টাকা।

এ খাতের আরেক কোম্পানি ন্যাশনাল টিউবসের গত ৫২ সপ্তাহে প্রতি শেয়ারর সর্বনিম্ন দর ছিল ৭২ দশমিক ২০ টাকা। আর এ সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ দর গিয়ে দাঁড়ায় ১৫৬ দশমিক ৯০ টাকা। অর্থাৎ বছরের মধ্যে এ কোম্পানির বিনিয়োগকারীরা সর্বোচ্চ মুনাফা করে ১১৭ দশমিক ৩১ শতাংশ।

এদিকে বিডি থাইয়ে গত এক বছরে বিনিয়োগ করে সর্বোচ্চ ১৭১ দশমিক ১১ শতাংশ মুনাফা করতে পেরেছেন বিনিয়োগকারীরা। খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের বঙ্গজ লিমিটেড গত এক বছরে দর বেড়েছে ১৩৯ দশমিক ৯১ শতাংশ। এ সময়ে সর্বনিম্ন শেয়ার ছিল ৯৫ দশমিক ২০ টাকা ও সর্বোচ্চ শেয়ারদর ছিল ২২৮ দশমিক ৪০ টাকা। এ খাতের শ্যামপুর সুগার মিলসের বছরে সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ শেয়ারদর বাড়ে ৫০৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ। গত এক বছরে ‘জেড’ ক্যাটাগরির এ কোম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধি ছিল চোখে পড়ার মতো। একই খাতের মেঘনা পেইটির শেয়ারদর সর্বনিম্ন অভিহিত মূল্যের নিচে ছিল। ৪ দশমিক ৯০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ছিল ১১ দশমিক ৭০ টাকা। অর্থাৎ বছরের মধ্যে শেয়ারদর বেড়েছে ১৩৮ শতাংশ।

অন্যদিকে খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের গোল্ডেন হার্ভেস্টে বিনিয়োগ করে সর্বোচ্চ ১৫৫ শতাংশ মুনাফা করেছে বিনিয়োগকারীরা। গত এক বছরে ২৩ দশমিক ৮০ টাকা থেকে ৬০ দশমিক ৮০ টাকায় কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয়। বস্ত্র খাতের রহিম টেক্সটাইলের গত এক বছরে সর্বোচ্চ শেয়ার বাড়ে ১০৫ শতাংশ। আর বস্ত্র খাতের আরেক কোম্পানি তাল্লু স্পিনিংযের শেয়ারদর বছরে সর্বনিম্ন ছিল সাত দশমিক ৯০ টাকা। আর এ সময়ে সর্বোচ্চ ছিল ২৭ টাকা। অর্থাৎ বছরের মধ্যে বিনিয়োগকারীরা সর্বোচ্চ মুনাফা পেয়েছে ২৪১ শতাংশেরও বেশি। এদিকে ২০১৫ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত শাশা ডেনিমসের গত এক বছরে শেয়ারদর বাড়ে ১৬৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। আর বিমা খাতের প্রগতি লাইফের ১২১ শতাংশের বেশি দর বাড়ে। পেনিনসুলা চিটাগং হোটেলে গত এক বছরে বিনিয়োগ করে সর্বোচ্চ মুনাফা বা শেয়ারদর বাড়ে ১৯৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ। অন্য কোম্পানি জ্বালানি খাতের ইস্টার্ন লুব্রিক্যান্টসের শেয়ারদর বাড়ে প্রায় ৪০০ শতাংশ। গত ৫২ সপ্তাহে সর্বনিম্ন শেয়ার লেনদেন হয় ৩০০ টাকায়। আর সর্বোচ্চ শেয়ারদর ছিল এক হাজার ৪৯৮ টাকায়। অর্থাৎ এ কোম্পানির বিনিয়োগকারীরা সর্বোচ্চ ৩৯৯ দশমিক ১৬ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করে।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘পুঁজিবাজারের শেয়ারের দর বাড়বে বা কমবে এটা স্বাভাবিক বিষয়। তবে দর যদি খুব বেশি হয়ে যায়, তবে সেটা চিন্তার কারণ। আর যখন দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দর এভাবে বাড়ে, তবে সেটা ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে এ ধরনের কোম্পানিতে বিনিয়োগের আগে অবশ্যই ভাবতে হবে। কারণ ভালো কোম্পানিতে রিটার্ন কম পেলেও ঝুঁকি কম থাকে।’

একই প্রসঙ্গে ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘বিনিয়োগকারীরা যদি বোঝেন যে, কোনো কোম্পানির শেয়ারের দর বেশি বা ওভার-ভ্যালু হয়ে গেছে তবে তাকে ওই কোম্পানি থেকে সরে আসা উচিত।’

তিনি বলেন, ‘মনে রাখা দরকার, যে কোম্পানিগুলো মৌলভিত্তির বিচারে পিছিয়ে আছে, সেসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ লাভের চেয়ে ঝুঁকির শঙ্কাই বেশি। এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক হওয়ার বিকল্প হতে পারে না।’