প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

শীতার্তদের প্রতি উষ্ণ মানবিকতা আগে প্রয়োজন

আলী আহসান: পউষের প্রবল শীত সুখী যেজন।

তুলি পাড়ি আছারি শীতের নিবারণ॥

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বাস্তবধর্মী রচনার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী রচিত ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যের ‘ফুল্লরার বারমাস্যা’।

বারমাস্যার ন্যায় আমাদের দেশের বাস্তুহারা, পথশিশুদের বারো মাসে বারো ধরনের সমস্যা দেখা যায়। একদিকে যেমন উৎসব আমেজে উজ্জীবিত বাঙালি বারো মাসে তেরো পার্বণ নিয়ে হাজির হয় সেখানে এই বাস্তুহারা পথশিশুদের নিকট বারো মাসে হাজারো সংকট এসে হাজির হয়। ঋতুর পালাবদলে তাদের জীবনের সমস্যা সংকটেরও পরিবর্তন ঘটে। রোদ, বৃষ্টি, ঝড় এই সময়ে তারা কোনো এক পথছাউনি, গাছের নিচে, ফুটপাতের মধ্যে কিঞ্চিৎ কাপড় পড়ে কাটিয়ে দেয়। কিন্তু শীতকালে তাদের জীবনে এক দুঃসহ কষ্ট নেমে আসে। শীতের সময়ে শহরের রাস্তায়, বিভিন্ন উদ্যান বা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যদি কখনও সকালে হাঁটেন দেখতে পারবেন কীভাবে এক বস্ত্র পরিধান করে শুয়ে আছে। প্রথম দেখায় এদের আপনার মৃত মানুষ বলে মনে হলেও লক্ষ্য করে দেখবেন সূর্যের আলোয় উষ্ণ প্রতিফলনে এরা ধীরে জেগে ওঠে। তবে কেউ আবার চাইলেও জেগে উঠতে পারে না চিরতরে ঘুমিয়ে পড়ে।

আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে শীতকাল কোনো অংশে কম যায় না। শীতকে কেন্দ্র করে কত রকম আয়োজন করা হয় এবং নানান রকম মধুর স্মৃতি আমাদের শৈশব, কৈশোরে জমা রয়েছে। কুয়াশাজড়ানো শীতের সকালে বাড়িতে বাড়িতে উৎসব আমেজ করে পিঠাপুলি খাওয়া ভোজনরসিক বাঙালির কাছে এক অনন্য সংযোজন। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান এই তিন সংকট যাদের মধ্যে নেই তারা শীতকে উৎসবে আমেজে গ্রহণ করে কিন্তু যাদের প্রতিনিয়ত এই তিন সংকটের সম্মুখীন হয় তাদের কাছে শীত চণ্ডী রূপে আবির্ভূত হয়ে প্রচণ্ড কষ্ট সৃষ্টি করে। রাস্তায় জীবন যাপনের সময় তাদের অন্নবস্ত্র বাসস্থানের প্রত্যেকটি অধিকার সমাজের নিকট থেকে জোর করে আদায় করে নিতে হয়। প্রথমত, অন্নবিনে ছন্নছাড়া জীবনে তারা রাস্তায় ঘুরে মানুষের থেকে চেয়ে, জোর করে, অনুনয় বিনয় করে কখনও বা চুরি করে তারা খাবার তথা অন্ন জোগাড় করে শুধু তাদের ছন্নছাড়া জীবনকে গতিময় করার জন্য। আর বাসস্থান সংকট দূর করার জন্য তো রয়েছে এই পুরো শহরের রাস্তাঘাট। শীতকাল বাদে বাকি সব মৌসুমে অন্ন ও বাসস্থান হলেও পথের বাসিন্দারা চলতে পারে কিন্তু শীতের সময় তাদের কাছে দেখা দেয় বস্ত্র সংকট। খাবার চুরি করে খেতে পারলেও কাপড়টা তারা সহজে জোগাড় করতে পারে না। এদিকে আবার তাদের শরীরে হাড্ডি মাংসসহ শীতে কেঁপে ওঠে। এজন্য তারা নরকের বস্তু আগুনের কাছে গিয়ে সাহায্য চায়। শীত যখন শরীরে অস্থিমজ্জায় নাড়া দেয় তখন তারা তাদের অর্ধবস্ত্রহীন শরীরকে আগুনে সঁপে দিতে চায় সঙ্গে কেউ কেউ তো শরীরের ভেতরে উষ্ণ উত্তাপ পাওয়ার জন্য আগুন ভক্ষণ করতে চায়। কিন্তু কোনো একসময় দেখা যায়, অমৃত অনুভূতিশীল খাদ্য আগুনই তাদের ভক্ষণ করে ফেলে। ফলাফল, শীতকালে আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় শোনা যায় আগুন পোহাতে গিয়ে মানুষ দগ্ধ হয়েছে সেখানে কেউ কেউ পঙ্গু হয়ে যায় চিরতরে আবার কেউ মারা যায়।

যখন শ্রাবণের বৃষ্টির মতো ঘন কুয়াশা পড়ে তখন উš§ুক্ত আকাশের নিচ থেকে সরে গিয়ে তারা ছাউনির আশ্রয়ে যায় আর তখন শীতবস্ত্র তাদের নিকট অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এরা যেমনি ক্ষুধার তাড়নায় চুরি করে তেমনি শীতের থেকে রেহাই পেতে শীতবস্ত্র চুরি করতে চায়। কিন্তু শীতবস্ত্র খাবারের ন্যায় সহজলভ্য না হওয়ায় চুরি করতে পারে না। অন্নাভাবে যেমন ক্ষুধার্ত মানুষের বলতে হয় ভাত দে না হয় পতাকা চিবিয়ে খাবো তেমনি তারাই আবার শীতের সময় কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বলে, শীতের কাপড় দে না হয় পতাকা খুলে পরিধান করব। সে কথা শোনার মতো মানুষও আমাদের চারপাশে নেই। আর তাইতো তাদের শরীরে বিভিন্ন পোস্টার, ব্যানার, বিলবোর্ডের কাপড় এবং বিভিন্ন জিনিসের ব্যাগ বস্তা পরিধান করতে দেখা যায় শুধু শরীরকে একটু উষ্ণ রাখবে বলে।

শীতকালে ঢাকাসহ বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলের মধ্যে উপরোক্ত চিত্র হরহামেশাই পথিকের চোখে পড়ে। এ সংকটগুলো বারবার আমাদের মানবিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এসব সংকট সমাধান করা যেমন সরকার ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব তেমনি সাধারণ জনগণ ও আমরা যারা এ বিষয়গুলো অনুধাবন করি তাদেরও দায়িত্ব। অনেক সময় দেখা যায়, সরকার বৃহৎ পরিসরে এসব বিপদাপন্ন মানুষকে সাহায্য করলেও প্রান্তিক পর্যায়ে এককভাবে অনেক ব্যক্তি এর থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ প্রায় দেখা যায়, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই সরকারের সাহায্যকৃত অর্থ আত্মসাৎ করে ফেলে। কাজেই ব্যক্তি পর্যায়ে সমাজে শিক্ষিত মানবিক শ্রেণিকে শীতার্তদের সাহায্য করার বিষয়টি গ্রহণ করা দরকার। ক্ষুদ্র পর্যায়ে আমাদের মানবিক সচেতনতায় একজন শীতার্তকে উষ্ণ রাখতে পারে। এই তো সম্প্রতি ফুটবল বিশ্বকাপকে গিয়ে আমাদের দেশের মানুষ কত টাকায় না খরচ করছে, যদিও এর থেকে কোনো লাভ আদৌও পাওয়া যাবে কি না তা একমাত্র ওই ব্যক্তিরাই বলতে পারব। জার্সি পতাকা ক্রয়ে ন্যূনতম কতশত টাকা চলে যাচ্ছে শুধু একটি মাসের জন্য। আমাদের এই ক্ষুদ্র পরিসরে টাকাগুলো একত্রে একটি বৃহৎ সাহায্য হয়ে উঠতে পারত। কাজেই সর্বোপরি বলব, শীতার্ত মানুষের প্রতি আমাদের উষ্ণ মানবিকতায় পারে তাদের কষ্ট দূর করতে।

        শিক্ষার্থী

        ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়