রফিক মজিদ, শেরপুর: শেরপুরে ৬৪টি ইটভাটার মধ্যে ৬১টিই অবৈধ। ক’দিন পরপরই প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত জরিমানা এবং অবৈধ ইটভাটা গুঁড়িয়ে দিলেও হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই চলছে ওইসব অবৈধ ইট ভাটার কার্যক্রম। খোদ ইটভাটা মালিকরা অবৈধ ইটভাটার কথা স্বীকার করলেও থামাচ্ছেন না কর্যক্রম।
শেরপুর পৌরসভার মোবারকপুর এলাকার আর এইচ ব্রিকস্রে স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলী বলেন, শেরপুরের ইট ভাটাগুলোর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা চলমান। যেকোনো সময় সব ইটভাটা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কোনো ভাটারই বৈধ কাগজপত্র নেই। শেরপুরের অর্ধেক ইটভাটা কাঠ ব্যবহার করে আর অর্ধেক ব্যবহার করে কাঠ এবং কয়লা। শেরপুরের সব ইট ভাটাই অবৈধ।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, শেরপুরে ইটভাটার সংখ্যা ছিল ৬৪টি। তার মধ্যে বৈধ ইটভাটা তিনটি, যথাক্রমে শ্রীবর্দী জিগজ্যাগ ব্রিকস, মেসার্স হ্রদয় ব্রিকস এবং আর এস জিগজ্যাগ ব্রিকস। এরই মধ্যে জেলার নয়টি ইটভাটা হাইকোর্টের নির্দেশে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ৫২টি ইটভাটার কোনো কাগজপত্রই নেই। পরিবেশ অধিদপ্তর এ ইটভাটাগুলোকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। আরও জানা যায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ৬টি ইটভাটায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ১৮ লাখ টাকা জরিমানা ও ২টি ইটভাটা ভেঙে দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর এবং ২০২৩ সালের চলতি মাসের ১৮ তারিখে ১৬টি ইটভাটায় ৪১ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করে পরিবেশ অধিদপ্তর। তারপরেও থেমে নেই এসব অবৈধ ইটভাটার কর্মযজ্ঞ।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, এসব অবৈধ ইটভাটায় পোড়ানো হচ্ছে কয়লার বদলে কাঠ। শ্রমিক হিসেবে খাটানো হচ্ছে ১০-১২ বছর শিশুদের। ফসলি জমির উর্বর মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়। এক শ্রেণির দালাল কৃষকদের অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে মাটি বিক্রি করতে বাধ্য করছে। দিন দিন উর্বর মাটি কমে যাওয়ায় হুমকিতে পড়েছে কৃষি আবাদ। কৃষি অফিস বলছে, দ্রুত মাটি কাটা বন্ধ না হলে কৃষি উৎপাদন বড় ধরনের বিপর্যয়ে পড়বে। সদর উপজেলার বাজিতখিলা ইউনিয়নে অবস্থিত জিহান ব্রিকস বিসাক্ত গ্যাস ছেড়ে দেয়ায় সেখানকার স্থানীয় কৃষকদের প্রায় ১০০ একর ফসলি জমির ধান নষ্ট হয়ে যায়। এটা নিয়ে স্থানীয় কৃষকরা আন্দোলন করলেও প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ক্ষতিপূরণ পর্যন্ত দেয়া হয়নি কৃষকদের। পরে অনেকে সেই জমি কম মূল্যে বিক্রি করে অন্যত্র চলে যায়।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ছমিদুল জানান, জিহান ইট ভাটার বিষাক্ত গ্যাসের কারণে গত বছর আমাদের এলাকার সব কৃষকের ধান নষ্ট হয়ে গেছে। গাছের কোনো ফল ধরে না, কয়লার ধোঁয়ায় আমরা ঘরে থাকতে পারি না।
স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, জিহান ব্রিকস্রে মালিক শেরপুরের সবচেয়ে ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি, তার কাছে প্রশাসন কিছুই না। কোনো প্রকার কাগজপত্র ছাড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ইটভাটা। ভাটার পাশেই রয়েছে একটি প্রাইমারি ও একটি হাইস্কুল এবং একটি বাজার।
ইটভাটার মালিক আবদুল হাই বলেন, আমি ৩০ থেকে ৩৫ বছর ধরে ইটের ব্যবসা করি। সরকার আমাদের প্রণোদনা এবং পৃষ্ঠপোষকতা করলে সামনের বছর থেকেই আমরা পরিবেশবান্ধব ইট তৈরিতে বিকল্প চিন্তা করব।
ইউনিব্লক (কংক্রিটের ইট) উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ফিউচার ব্লকের মালিক প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল আলামিন বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেক ইঞ্চি মাটিকে উৎপাদনের আওতায় আনতে বলেছেন, সেটা বাদ দিয়ে আমরা কৃষিকে ধ্বংসের প্রতিযোগিতায় নেমেছি। আমাদের এখনই পোড়া মাটির ইট ব্যবহার না করে পরিবেশ বান্দব ইট ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিন ভয়েসের শেরপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মারুফুর রহমান বলেন, পরিবেশ বিনষ্টকারী অবৈধ ইটভাটা নিয়ে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও এবং বারবার মোবাইল কোর্টে জরিমানা ও ভাটা ভেঙে দেয়ার পরও কীভাবে প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব ইটভাটা এখনও সচল থাকে তা বোধগম্য নয়। তবে আমরা মনে করি, এসব ইটাভাটা বন্ধের পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তির পরিবেশবান্ধব ব্লক ইটভাটার প্রতি সাধারণ মানুষ এবং ভাটা ব্যবসায়ীদের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টিতে সচেনতা বাড়াতেও সরকারের কাজ করা উচিত।
শেরপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আল মাহমুদ বলেন, যারা অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করবে না বা অনত্র সরিয়ে না নিবে তাদের বিরুদ্ধে আইননানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা মহাপরিচালক আমাদের দিয়েছেন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের ময়মনসিংহ বিভাগীয় উপপরিচালক রুবেল মাহবুব বলেন, ইটভাটা প্রস্তুত আইন অনুযায়ী ভাটা নির্মাণ না করলে সে গুলোকে ভেঙে দেয়া হবে এবং ভাটা মালিকদের আমরা পরামর্শ দিচ্ছি তারা যেন আগামী বছর অন্য পরিবেশবান্ধব ইট প্রস্তুতের প্রস্তুতি নেয়।