সংবিধানের ২৯ (১) অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগের সমতা থাকবে।’ এক্ষেত্রে কোটাধারী ব্যক্তিরা নিয়োগ লাভের ক্ষেত্রে বেশি সুবিধা ভোগ করছে। তš§ধ্যে পোষ্য কোটা চালু থাকার কারণে সরকারি চাকরিজীবী যারা তাদের সন্তানদের পোষ্য কোটার মাধ্যমে বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। ফলে যোগ্য ও মেধাবী চাকরি প্রার্থীদের পদ বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা কয়েকগুণ বেশিই বলে মনে করা হয়। প্রসঙ্গত, পৌষ্য কোটাধারীরা যে একেবারেই যোগ্য-মেধাবী নয়, তা বলা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। তবে বাংলাদেশের যেকোনো নিয়োগ পরীক্ষার ক্ষেত্রে সাধারণ শ্রেণি ও পৌষ্য কোটাধারীদের সুযোগ যেন পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিস্ফুট হয় না।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। বিশেষভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য চালু করা হয় এ কোটা। কিন্তু সাধারণ ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের চাকরিপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে এটি একটি বড় বাধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তান আমলে মানুষ চাকরি পেত না পক্ষপাতিত্বের কারণে কিন্তু বর্তমান সময়ে মানুষ চাকরি পাচ্ছে না কোটা ব্যবস্থা নামক বৈষম্যের কারণে। বর্তমান সময়ে কোটা ব্যবস্থার যে পদ্ধতি রাখা হয়েছে সেটি যেন পূর্ববর্তী অনিয়ম আর অসম নীতিকেই আরেকবার মনে করিয়ে দিচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে পোষ্য কোটার কোনো যৌক্তিকতা পরিলক্ষিত হয় না, বরং পোষ্য কোটাকে সম্পূর্ণভাবে একটি বৈষম্যমূলক নীতি হিসেবেই বিবেচনা করা যায়।
বিশ্বের পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কোটা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সেখানে দলিত, পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠীকে তাদের মূল জনগোষ্টীর সে াতধারায় ফিরিয়ে আনতে কোটা ব্যবস্থা চালু রাখা হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থার যে সুবিধা রাখা হয়েছে তার পরিমাণ খুবই সীমিত। পরবর্তী সময়ে পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠীর অবস্থার উন্নতি ঘটলে কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করা হয়। পাকিস্তান এবং ভারতের ক্ষেত্রে এমন সংস্কার লক্ষ্য করা যায়। উন্নত দেশে কোটা ব্যবস্থা চালু থাকলেও এটির পরিধি অনেকটাই সীমিত। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা থেকে শুরু করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০ শতাংশ, রেলওয়ে বিভাগে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত পোষ্যকোটা বিদ্যমান। এছাড়া পুলিশ বিভাগসহ অন্যান্য সেক্টরেও বৈষম্যমূলক পোষ্যকোটার আধিখ্যেতা লক্ষ্য করা যায়। পোষ্যকোটার কারণে যারা সরকারি চাকরিজীবী তাদের সন্তানদেরও চাকরি লাভের সম্ভাবনা বেশি থাকে। এতে করে গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে সমাজে একই সঙ্গে একটি পুঁজিবাদী ও শোষিত শ্রেণি তৈরি হচ্ছে। অযোগ্য ব্যত্তিরা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্তির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হলে স্বভাবতই দুর্নীতি ও অনিয়মের মতো কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়ে থাকে।
বিভিন্ন পরীক্ষা কোটার সুবিধা যেন ‘তেলা মাথায় তেল দেয়া মনুষ্য জাতির রোগ’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই উক্তিটির সঙ্গে বাংলাদেশের কোটা ব্যবস্থার একটি চমকপ্রদ সাদৃশ্য বিদ্যমান বললে আদৌ ভুল হবে বলে মনে হয় না। খেয়াল করে দেখি, ২০১৮ সালে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফলে সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি থেকে কোটা ব্যবস্থা বিলুপ্ত করলেও অন্যান্য শ্রেণির চাকরির ক্ষেত্রে এটি বজায় থাকে। ফলে পোষ্যকোটার সুবিধাগুলো একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী ভোগ করে আসছে।
বর্তমান সময়ে কোটা ব্যবস্থা একটি বহুল আলোচিত বিষয়। অর্থাৎ একই পরিবারে একাধিক ব্যক্তি চাকরি লাভের কারণে তারা স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে ঠিকই, কিন্তু অন্যদিকে সাধারণ চাকরিপ্রার্থীরা তাদের মেধা ও যোগ্যতা থাকার পরও কোটা নামক বৈষম্যের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়ছে। তাই প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ, রেলওয়ে বিভাগে নিয়োগসহ সব ধরনের নিয়োগ ও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে পোষ্যকোটা বাতিল করা উচিত। আর যদি সুবিধা দেয়াই হয় তাহলে দিনমজুর, কৃষক, শ্রমিক এই ধরনের পরিবারের ছেলেমেয়ে দেয়া উচিত নয় কি? জানা জরুরি, বৃষক ও শ্রমিকের ওপর নির্ভর করেই দেশের অর্থনীতির ভিত্তি সুদৃঢ় হয়েছে তদুপরি তারাই সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণি। সেদিক বিবেচনায় কোটা ব্যবস্থার মাধ্যমে যে সুবিধা ও সমতা বিধানের নীতি সেটি কেবল পিছিয়ে পড়া শ্রেণির জন্যই প্রযোজ্য হওয়ার কথা। আর এটি সম্ভব না হলে চাকরিক্ষেত্রসহ অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে পোষ্যকোটা নামের প্রহসন অবিলম্বে বাতিল ঘোষণা করে দেয়া সময়ের দাবি।
মারজান হোসেন
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়