প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

সাত বিভাগে ব্যাংক আমানত কমেছে

রোহান রাজিব: দ্রব্যমূল্যর ঊর্ধ্বগতির কারণে বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। নিন্ম ও মধ্যবিত্তরা সংসারের খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। সাধারণ মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে দিশাহারা। এমন পরিস্থিতিতে অর্থ জমানো তো দূরের কথা, অনেকে ব্যাংকে থাকা টাকা তুলে খাচ্ছেন। ফলে গত তিন মাসে দেশের সাত বিভাগে ব্যাংকগুলোয় আমানতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে ঢাকা বিভাগ ছাড়া সারাদেশের ব্যাংক আমানত কমেছে। এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ঢাকা বিভাগ ছাড়া বাকি সাত বিভাগে আমানত ছিল ছয় লাখ ১৯ হাজার ৯০২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে তা কমে ছয় লাখ আট হাজার ৫০০ কোটি ৫২ লাখ টাকায় দাঁড়ায়। তবে এসময় ঢাকা বিভাগে আমানত ৯ লাখ ৫৫ হাজার ৯২০ কোটি ২৯ লাখ থেকে বেড়ে ৯ কোটি ৬৭ লাখ ৮৭০ কোটি ১৪ লাখ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির কারণে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়েছে, তাই মানুষকে বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। অনেক সঞ্চয় ভেঙে এ খরচ মেটাচ্ছেন। আবার কেউ সঞ্চয় করতে পারছেন না এবং চলমান অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব পড়েছে ব্যাংক আমানতে। এছাড়া অনিয়মের কারণে ব্যাংক খাতের ওপর আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এর একটা প্রভাবও লক্ষ করা যায়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চট্টগ্রামে আমানত কমেছে পাঁচ হাজার ২১১ কোটি টাকা, খুলনায় এক হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা, ময়মনসিংহে ৭৮ কোটি টাকা, রাজশাহীতে ৫৫০ কোটি টাকা, বরিশালে ৮০০ কোটি টাকা, সিলেটে ২৫৬ কোটি টাকা এবং রংপুরে ৭৫০ কোটি টাকা।

এদিকে ঢাকায় আমানত বেড়েছে ১১ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা। ঢাকা বিভাগে আমানত বৃদ্ধির ওপর ভিত্তি করে, ব্যাংক খাতে মোট আমানত দুই হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা বা দশমিক ১৬ শতাংশ বেড়েছে। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়ে ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি ৬৬ লাখ টাকায় পৌঁছেছে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি আনিস এ খান শেয়ার বিজকে বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। তাই মানুষের আগের তুলনায় খরচ বেশি হচ্ছে। এজন্য মানুষের হাতে টাকা বেড়ে গেছে। তাই দিন শেষে বা মাসের শেষে তার আয়ের একটি অংশ আর ব্যাংকে জমা রাখছেন না।

তিনি আরও বলেন, অনিয়মের কারণে ব্যাংক খাতের ওপর আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এর একটা প্রভাবও লক্ষ করা যায়। সাধারণত ঢাকা বিভাগের বাইরের অঞ্চলে বেশি উদ্বেগজনক।

জ্বালানির দাম বৃদ্ধি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়েছে। গত আগস্টে এক লাফে দ্বিগুণ হয়ে যায় জ্বালানির দাম। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশে আমদানি ব্যয় ও পণ্যের দাম উভয়ই আকাশচুম্বী হয়। এতে করে বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি। এর প্রভাব পড়ে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ে। এতে মানুষের সঞ্চয় করা কমে যায়, যা ব্যাংক আমানতে একটা প্রভাব ফেলে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মতে, জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ, যা আগস্টে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে উন্নীত হয়, যা এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। পরে সেপ্টেম্বরে কমে ৯ দশমিক ১০ শতাংশে, অক্টোবরে ৮ দশমিক ৯৯ শতাংশে আর নভেম্বরে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশে নেমে আসে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের অক্টোবর শেষে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে অর্থের পরিমাণ দুই লাখ ৩৬ হাজার ১১৪ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। গত বছরের একই সময়ে এ পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৫৮ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে নগদ অর্থ ৩০ হাজার ২১৯ কোটি টাকা বা ১৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেড়েছে। তবে সেপ্টেম্বরে মানুষের হাতে নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৩৯ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা।

চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে আমানতের বৃদ্ধি ছিল প্রায় চার শতাংশ, যা পরে সেপ্টেম্বরে শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশে নেমে আসে। আশানুরূপ আমানত না বাড়ায়, এটি ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট তৈরি করে। ২০২১ সালের অক্টোবরে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ২ লাখ ২০ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে অতিরিক্ত তারল্য কমে এক লাখ ৭০ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। অর্থাৎ ১১ মাসে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে ৫০ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, গত কয়েক মাসের অধিক মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাংকের আমানতের ওপর একটা প্রভাব পড়েছে। মূল্যস্ফীতির ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। সঞ্চয় করার সক্ষমতা নেই। ব্যয় যতটা বেড়েছে, আয় ততটা বাড়েনি। তাই মানুষ সঞ্চয় থেকেও ভেঙে খাচ্ছেন। এর ফলে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন।

তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি কিছু কেলেঙ্কারির ঘটনা গঠছে, যা অতিমাত্রায়। এমন একটি ব্যাংকের কাছ থেকে ঘটনা ঘটানো হচ্ছে, যেটা সবচেয়ে বড় একটি ব্যাংক। এসব ঘটনার কারণে ব্যাংক খাতের ওপর মানুষের আস্থা কমে গেছে। এজন্য গ্রামের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে টাকা তুলে ফেলছে।