প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

সুনাম ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে বাটা

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ ও নাজমুল হুসাইন: একসময় সারা দেশে বাটা জুতার খুব চাহিদা ছিল। ছেলে-বুড়ো সবার পছন্দের তালিকায় ছিল এই জুতা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবস্থারও পরিবর্তন হয়েছে। বাজারে চলে এসেছে বাটার প্রতিযোগী বেশকিছু কোম্পানি। যে কারণে এ পণ্যটির চাহিদা কমে গেছে। এতে কমেছে বাটার উৎপাদন ও রফতানি। ফলে টিকে থাকতে কৌশলী হয়েছে কোম্পানিটি।

অভিযোগ রয়েছে, ভিনদেশি পণ্য এনে তা গ্রাহকের কাছে বাটা বলে চালিয়ে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে প্রতারিত হচ্ছেন গ্রাহক। এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানটি ভালো লভ্যাংশ দিলেও এর শেয়ারের চাহিদা আগের চেয়ে কমে গেছে। দুবছর আগে এর শেয়ার এক হাজার ৪১৭ টাকায় লেনদেন হলেও এখন তা বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ১৮৫ টাকায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে উৎপাদন কমে যাওয়ায় শোরুমগুলোয় চীন থেকে নিম্নমানের জুতা কিনে এনে নিজেদের শোরুমে সাপ্লাই দেওয়া হচ্ছে যা ওইসব জুতার মানের নয়। তবে শুধু বাটার ব্র্যান্ডিংয়ে ভরসা করেই এসব জুতা কিনছে সাধারণ মানুষ। আর নিম্নমানের এসব জুতায় প্রতারিত হচ্ছেন অনেকে।

সরেজমিনে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিজস্ব নামের ব্র্যান্ডের পাশাপাশি আরও ১৮টি ব্র্যান্ডের জুতা বিক্রি করছে বাটা কোম্পানি, যার প্রায় সবগুলোই বিদেশি। এগুলোর মধ্যে নাইকি এবং পাওয়ারের মতো হাতেগোনা দু-একটি ব্র্যান্ডের নামডাক থাকলেও অধিকাংশই চায়না থেকে আমদানি করা বেনামি নিমানের জুতার ব্র্যান্ড। শোরুমগুলোয় এখন নিজেদের দেশি কারখানায় তৈরি জুতা থেকে বিদেশি ব্র্যান্ডের জুতাই বেশি। পাটা পাটা, ব্যালেরিনা, স্কল, লাইট অ্যান্ড ইজি, ব্যাবেলস বেবি, ব্যাবেলস গুমার, মকাসিনো, স্পারেক্স, নর্থ স্টার, উইনবার্নার, বি ফাস্টে নামের এসব ব্র্যান্ডের জুতা বিক্রি হচ্ছে বাটা ব্র্যান্ডিংয়ে।

নিম্নমানের এসব জুতা বিক্রি করায় অভিযোগেরও শেষ নেই কোম্পানিটির বিরুদ্ধে। ক্রেতারা বলছেন, সাধারণ মানুষ অনেক দাম দিয়ে এসব জুতা কিনে বেশিদিন ব্যবহার করতে পারেন না। কয়েক দিন যেতে না যেতেই জুতার সোল ভেঙে যায়। বডির নানা অংশের পেস্টিং খুলে যায়। ওয়ারেন্টির মেয়াদকালে এসব জুতা নিয়ে প্রতারিত মানুষ শোরুমগুলোয় ভিড় করলেও অভিযোগ লিখিয়ে নিয়ে জুতা ছাড়া খালি হাতেই তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

গতকাল রামপুরায় বাটা শোরুমে প্রতারিত ক্রেতা মফিজুর রহমান ওয়ারেন্টি সেবা পেতে ভোগান্তির কথা উল্লেখ করে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বাটা জুতা রিপ্লেস দেবে না; আবার মানুষকে হয়রানি করছে। এর মানে কি? জুতার কোয়ালিটি এত নিম্নমানের যে, এক মাসেই পেস্টিং খুলে গেছে। বিক্রির সময় নিজেদের জুতা বললেও এখন ওয়ারেন্টি সেবা দিতে গিয়ে বলে, বিদেশি পণ্য তো… তাই দেরি হচ্ছে।’

শুধু ক্রেতাই নন, এসব নিম্নমানের বাটা কোম্পানির জুতা নিয়ে ক্ষোভ সংসদীয় কমিটিরও। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে অনুষ্ঠিত শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ১২তম বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনায় ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। সে সময় সদস্যরা জানান, চীন থেকে নিম্নমানের জুতা কিনে এনে দেশে নিজেদের নামে বাজারজাত করে দেশের জনগণের সঙ্গে বাটা একধরনের প্রতারণা করছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বাটার শ্রমিক অসন্তোষের বিষয়টি আলোচনাকালে এ মন্তব্য উঠে আসে।

অন্যদিকে বাটার দেশে তৈরি নিজস্ব জুতায়ও ম্নমানের কাঁচামাল ব্যবহারের অভিযোগ বেশ পুরনো। মুনাফা বাড়াতে তাদের বেশিরভাগ জুতাই তৈরি হচ্ছে বাইরের অন্য প্রতিষ্ঠানের কারখানায়। বাটায় জুতা সরবরাহকারী এ ধরনের একাধিক কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাটা কোম্পানির দেশে তৈরি অর্ধেক জুতার জোগান দেয় তারা। তবে বাটার দেওয়া কম মূল্যমানের কারণে ভালো মানের জুতা সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান সরবরাহকারীরা। আর মুনাফা বাড়াতেই তাদের নিজেদের কারখানায় জুতা তৈরির হারও কমিয়ে দিয়েছে বাটা।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এ কোম্পানির জুতা বিক্রি দিন দিন কমে যাচ্ছে। টার্নওভার বাড়লেও গত পাঁচ বছর ধরে বাটা সু কোম্পানি লিমিটেডের জুতা বিক্রি কমছে। জানা যায়, ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠানটি তিন কোটি ২৪ লাখ এক হাজার জোড়া জুতা বিক্রি করে। ২০১৪ সালে তা নেমে আসে দুই কোটি ৯০ লাখ ৫০ হাজার জোড়ায়। তুলনামূলক কম মূল্যের জুতার বিক্রি কমাতেই বিক্রির পরিমাণ কমছে। তবে মধ্যম ও উচ্চ মূল্যমানের জুতা এবং অ্যাকসেসরিজের সুবাদে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে টার্নওভার। ২০১৫ সালে কোম্পানিটি জুতা উৎপাদন করে দুই কোটি ৬৬ লাখ জোড়া।

এদিকে বাংলাদেশ থেকে বাটার রফতানি ক্রমেই কমছে। ২০১৪ সালে বাটা সু’র রফতানি থেকে আসে আট কোটি ৯৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকা, যা ২০১৫ সালে কমে দাঁড়ায় ছয় কোটি ৪৪ লাখ ২৬ হাজার টাকা।

এ প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির সচিব হাশেম রেজা শেয়ার বিজকে বলেন, বর্তমানে আমাদের লক্ষ্য লোকাল মার্কেট। কারণ রফতানিতে আমরা তেমন সুবিধা পাই না। সে কারণে আমরা চাচ্ছি দেশের বাজার ভালোভাবে ধরে রাখতে। তবে মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে জুতা রফতানি বাড়াতেও আমরা পদক্ষেপ নেব।

বিদেশ থেকে জুতা আমদানি প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চাহিদা অনুযায়ী বাইরে থেকে আমরা কিছু উন্নত মানের জুতা অর্ডার দিয়ে বানিয়ে আনি। সেটা ক্রেতাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখেই করা হয়।

বাটা সু’র নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৪ সালে কোম্পানিটির টার্নওভার ছিল ৮০৭ কোটি ৬৯ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। গত বছর যা দাঁড়িয়েছে ৮৫২ কোটি ২৮ লাখ দুই হাজার টাকা।

বহুজাতিক এই কোম্পানি ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। তখন দেশের সবখানে একচেটিয়া ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠানটি। পরবর্তীতে দেশি কয়েকটি কোম্পানি জুতা রফতানির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য বিক্রি শুরু করায় বাটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। বর্তমানে এই ধারা অব্যাহত রয়েছে।

ডিএসই থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, দুবছর আগে এ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদর ছিল এক হাজার ৪১৭ টাকা। ভালো লভ্যাংশ দেওয়ার পরও এখন সেই শেয়ার বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ১৮৫ টাকায়। কোম্পানিটি সর্বশেষ শেয়ারহোল্ডারদের ৩২০ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়। গত এক বছরের মধ্যে এ শেয়ার সর্বোচ্চ এক হাজার ৩৩৫ টাকা এবং নিম্ন এক হাজার ১১০ টাকায় লেনদেন হয়।