প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

সুন্দরবন থেকে বন্যপ্রাণী পাচার রোধে ব্যবস্থা নিন

সুকান্ত দাস: টাকা থাকলে নাকি বাঘের দুধও পাওয়া যায়। এখনকার প্রেক্ষাপটে টাকা থাকলে বাঘের দুধ তো আছেই, এক্কেবারে বাঘই পাওয়া যায়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হলো আমাদের সুন্দরবন। আর সুন্দরবনের বণ্যপ্রাণীর মধ্যে মূল আকর্ষণ হলো রয়েল বেঙ্গল টাইগার। বিভিন্ন সময় বাঙালি বিশেষ বিশেষণ হিসেবে ‘টাইগার’ ব্যবহার করে। বাংলাদেশ পুরুষ ক্রিকেট দলকে টিম টাইগার বলা হয়, মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানীকে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বলতো পাপা টাইগার। বাংলার বাঘ বলা হতো আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে। আবুল কাসেম ফজলুল হককে বলা হতো শেরেবাংলা। বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীকে বলা হয় বাঘা সিদ্দিকী।

বাঙালিদের যেকোনো অর্জনেই টাইগার নামটা চলে আসে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের এই দেশে এসে সুন্দরবন ভ্রমণের মূল কারণ ওই বেঙ্গল টাইগার দেখা। মোটকথা, পৃথিবীর সব দেশ থেকে আমরা আলাদা পরিচয় বহন করি যে জিনিসগুলো থেকে তার একটা হলো সুন্দরবন, রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং সুন্দরবনের বিচিত্র প্রাণিকুল। কিন্তু অনেক প্রাণী আজ বিলুপ্তির পথে। পাচারকারীদের তাণ্ডব, নির্বিচারে গাছ কাটা, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বাসস্থান ধ্বংস হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং কিছু বিলুপ্তির পথে রয়েছে। কয়েক বছর ধরে সুন্দরবনের পশু পাচার মহামারি আকার ধারণ করেছে। হরিণ, বাঘ, তক্ষক, সাপ, হাতি, কচ্ছপসহ আরও অনেক প্রাণী পাচার হচ্ছে নির্বিচারে। তাদের যেন ঠেকানোর কেউ নেই, যার কারণে বাঘ, হরিণ, হাতিসহ জীবজন্তুর সংখ্যা অতি দ্রুত কমছে।

এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ১৯০০ সালের প্রথম দিকে বিশ্বের ১৩টি দেশে এক লাখ বাঘ থাকলেও বর্তমানে বাঘের সংখ্যা তিন হাজার ২০০টিতে এসে দাঁড়িয়েছে। টিআরএফএফআইসি’র প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বাঘ রয়েছে, এমন দেশে বাঘের ৬৫৪টি চামড়া, দেহাবশেষ ও হাড় জব্দ করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, এ সময়ে এক হাজার ৪২৫টি বাঘ মারা গেছে।

২০০৪ সালে ইউএনডিপি, বাংলাদেশ ও ভারতের বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় বাঘের পায়ের চিহ্নের ওপর ভিত্তি করে একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। সেই জরিপে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা দেখানো হয় ৪৪০টি। এর মধ্যে বাঘ ১২১টি, বাঘিনী ২৯৮টি ও বাচ্চা ২১টি। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ইউনিয়নের তালিকা অনুযায়ী বাংলাদেশে বাঘ রয়েছে ২০০টি। ১৯৭৫ সালের পর সুন্দরবনের বাঘ বাড়েনি।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত চোরা শিকারি ও বনদস্যুদের হামলা, গ্রামবাসীর পিটুনি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সুন্দরবনের প্রায় ৭০টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। তাদের রেকর্ড অনুযায়ী, ১৯৮২ সালে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৫৩টি। ২০০৪ সালে এ সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৪৪০টি। আর সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী বাঘের সংখ্যা ১০৬টি। বাঘের সংখ্যা কমেছে ৩৩৪টি।

একেক সংস্থার গবেষণায় বাঘের সংখ্যার একেক রকম পরিসংখ্যান উঠে এলেও একটি বিষয়ে সবার মতামত একই। তা হলো প্রতিটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বাঘের সংখ্যা অনেক কমে গেছে আগের তুলনায়।

আইইউসিএন বলছে, তিন প্রজন্মে হাতির সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। হাতি শিকার এবং পাচার বাড়ছে দিন দিন। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ ইউনিয়নের ২০১২ সালের প্রকাশিত এক তথ্যমতে, ২০০৩ থেকে ২০১২ এই ১০ বছরে মানুষের হাতে ৪৭টি হাতির মৃত্যু হয়েছে।

বাংলাদেশের কোন এলাকা থেকে কোন ধরনের বন্য প্রাণী পাচার হয়, তা নিয়ে যৌথভাবে একটি গবেষণা চূড়ান্ত করেছে ওয়ার্ল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটি (ডব্লিউসিএ) বাংলাদেশ এবং ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স (সিসিএ)। ‘বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী পাচারের বিরুদ্ধে লড়াই বর্তমান অবস্থা ও পরবর্তীতে করণীয়’ শীর্ষক ওই গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া বন্যপ্রাণীদের একটি বড় অংশের উৎস সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী দুই বিভাগ খুলনা ও বরিশাল। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট ও ঢাকার আশেপাশের বনাঞ্চল থেকে বন্যপ্রাণী পাচার হচ্ছে। পাচার হওয়া বন্যপ্রাণীদের ৮২ শতাংশ হরিণ। এরপর রয়েছে তক্ষক, সাপ ও বাঘজাতীয় প্রাণী।

সুন্দরবনের পশু শিকার ও পাচারের সঙ্গে একটা প্রভাবশালী মহল জড়িত। নিরাপত্তা বাহিনী বা বিভাগের কর্মকর্তাদের কিছু করার থাকে না, যে কারণে বাঘ, হরিণসহ অন্য জীবজন্তু পাচার বেড়েই চলেছে।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে দেশে আইন রয়েছে। ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিল, ২০১২’ অনুযায়ী বাঘ বা হাতি হত্যা করলে সর্বনি¤œ দুই বছর এবং সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ড। সর্বনি¤œ এক লাখ টাকা ও সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা হবে। একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি হলে সর্বোচ্চ ১২ বছরের কারাদণ্ড এবং ১৫ লাখ টাকা জরিমানা হবে। পাশাপাশি বন্যপ্রাণী অবৈধভাবে কিনলে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। লাইসেন্স ছাড়া কোনো ব্যক্তি কারও কাছ থেকে বন্যপ্রাণী, বন্যপ্রাণীর কোনো অংশ, মাংস বা কোনো দ্রব্য কিনলে সর্বোচ্চ তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা দুই লাখ টাকার জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।

সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন সময় বাঘের চামড়া, হরিণের মাংস, চামড়া, বাঘের দাঁতসহ পাচারকারী ধরা পড়ার খবর দেখলেও সেইসব লোকের শাস্তি হয়েছে, এমনটা শোনা যায় না। যদি এসব অপরাধীকে দেশের আইন অনুযায়ী যথাযথ বিচার করে শাস্তির আওতায় আনা যায় এবং এটা প্রচার করা যায়, তাহলে সুন্দরবনের পশু পাচার কমানো সম্ভব। সেইসঙ্গে প্রভাবশালীদের কারণে যাতে করে বন বিভাগের লোকজনের তাদের ওপর অর্পিত যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে অসুবিধা না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এটা আমাদের দেশের সম্পদ, দেশের ঐতিহ্যের অংশ।

পত্রিকার একটি প্রতিবেদন দেখে তো চক্ষু চড়কগাছ। দাকোপ উপজেলার অনেক গ্রামে হরিণের মাংস নিয়মিত বিক্রি হয়। কেজিপ্রতি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দরে মাংস বিক্রি হচ্ছে। এ বছরের শুরুতে প্রচুর পরিমাণ হরিণ শিকারের খবর পাওয়া যায়। জানুয়ারি মাসের শেষে এবং ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে হরিণের একটি মাথা, ১৯টি হরিণের চামড়া, ৭৮ কেজি মাংসসহ দুই চোরাকারবারিকে আটক করে কোস্টগার্ড ও পুলিশ।

বিভিন্ন পরিসংখ্যান এবং তথ্য দেখে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, সুন্দরবনের সবচেয়ে বেশি পাচারের ঝুঁকিতে আছে বাঘ ও হরিণ। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমনকি আমাদের দেশেও ঘর সাজাতে বাঘের চামড়া, হরিণের শিং ও হরিণের চামড়া ব্যবহার করা হচ্ছে। একটি বাঘের চামড়া ১৫-২০ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। বাঘের দাঁত  দোতারা তৈরিতে ব্যবহƒত হয়। বাঘের দাঁত ও নখ কিনতে পাওয়া যায় দক্ষিণ বঙ্গের কিছু বাজারে।

সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী বাইরে থেকে কেউ গিয়ে পাচার করতে পারে না, যদি না স্থানীয় কারও সহায়তা থাকে। সুন্দরবনের আশেপাশের এলাকায় কিছু অসাধু মানুষ বাইরের পশু পাচার চক্রের সঙ্গে যোগসাজশ করে সুন্দরবন থেকে পশু পাচার করে। অনেক সময় গাছ কাটতে এসে গাছের সঙ্গে পশু পাচার হয়ে যায়। এই পাচারকারী চক্রের সঙ্গে কিছু প্রভাবশালী মহলও জড়িত। এমনিতেই বন বিভাগের পর্যাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী নেই। তারপরও কিছু অসাধু কর্মকর্তা সুন্দরবনের পশু পাচারের সঙ্গে জড়িত। কারণ যত কমই নিরাপত্তারক্ষী থাকুক না কেন বারবার তাদের চোখ ফাঁকি দেয়াটা সম্ভব নয়। সরকারের উচিত এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া। সুন্দরবন বাংলাদেশের দুর্গ। আর সুন্দরবনের আসল সম্পদ হলো এখানের বিচিত্র প্রাণিকুল। সমগ্র বিশ্ব থেকে লাখ লাখ পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণে আসেন শুধু এই কারণে। প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা যুক্ত হচ্ছে দেশের কোষাগারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যেভাবে বন্যপ্রাণী পাচার হচ্ছে, তাতে দুই দশক পর অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাবে সুন্দরবন থেকে। সুন্দরবনের মূল আকর্ষণই যদি না থাকে, তাহলে বিদেশি পর্যটকও আসবে না। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ। আর সুন্দরবনের বিচিত্র প্রাণিকুল আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। সরকারের উচিত পশু পাচার বন্ধে যুগোপযোগী ব্যবস্থা নেয়া, বনবিভাগের জনবল বৃদ্ধি করা এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা। তাহলেই সুন্দরবনের পশু পাচার বন্ধ করা সম্ভব হবে।

শিক্ষার্থী, পরিসংখ্যান বিভাগ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়