জেদনী খাঁন : স্মার্টফোন হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভিডিও কন্টেন্ট দেখছে আপনার ছোট্ট শিশুটি। সামাজিক মাধ্যমের এই ভিডিও কনটেন্টগুলোর মধ্যে দিয়ে তার চোখের সামনে চলে আসছে বিভিন্ন শিশুখাদ্যের বিজ্ঞাপন। এর মধ্যে দিয়ে শিশুকালেই তারা হয়ে উঠছে বিজ্ঞাপনের টার্গেট।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখেরও বেশি। এর মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৯ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৫ কোটি।
দেশের প্রায় ৫ কোটি শিশুর বেশির ভাগই দিনের কোনো না কোনো সময় স্মার্টফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখছে। এর মধ্যে দিয়ে বিশালসংখ্যক শিশু হয়ে উঠছে ডিজিটাল বিজ্ঞাপণের অন্যতম বড় টার্গেট গোষ্ঠী।
সম্প্রতি ঢাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে, তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় প্রতিটি পরিবারের শিশু-কিশোররাই মোবাইল ফোনে বা ট্যাবে বা বাসার ল্যাপটপে ভিডিও কন্টেন্ট দেখতে পছন্দ করে।
ঘরে অবসর সময়ে, রাস্তায় গাড়িতে চলাকালে, স্কুলের সামনে বা বিপণিবিতানে, প্রায় সর্বত্রই মোবাইল ফোনে কোনো না কোনো শিশুর হাতে স্মার্টফোন দেখা যায়। এ দৃশ্য এখন খুব সাধারণ হয়ে উঠেছে। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, অনেক সময় বাবা-মা-ই সন্তানের কান্না থামাতে, কেনাকাটার সময় সন্তানকে ব্যস্ত রাখার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দেন। কিছুক্ষণ পর সেই ‘চুপ করানোর যন্ত্র’ই হয়ে ওঠে শিশুর একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম।
বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিশুদের পছন্দের ভিডিওগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যানিমেটেড কার্টুন, ফানি ভিডিও, খেলনার রিভিউ ও আনবক্সিং, বিনোদন মূলক ও চ্যালেঞ্জিং ভিডিও, ছোটদের ছড়া বা গান, শিশুদের গল্প, মোবাইল গেম এবং শিক্ষামূলক কনটেন্ট। এই ভিডিওগুলোর মাঝখানে খুব চাতুর্যপূর্ণভাবে ঢুকিয়ে দেয়া হয় বিজ্ঞাপন। কখনও সেটা চকলেট, কখনও জুস বা চিপস, বিস্কুট, মোবাইল অ্যাপ, দুধ-পানীয় ও পুষ্টিপণ্য, আইসক্রিম, শিশুদের পোশাক ও প্রোডাক্টস, টেক গ্যাজেট। আবার কখনও খেলনা বা গেমের বিজ্ঞাপনসহ মোট ৭ থেকে ৮ ধরনের বিজ্ঞাপন লক্ষ্য করা যায় শিশুদের পছন্দের ভিডিও কনটেন্টকে ঘিরে। এমনকি বয়সের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু পণ্যের বিজ্ঞাপনও সেখানে চলে আসে। এই প্রক্রিয়ায় ছোটবেলা থেকেই গড়ে তোলা হচ্ছে পণ্যনির্ভর, আকাক্সক্ষাপ্রবণ এক ‘ভোক্তা গোষ্ঠী’।
গবেষণায় দেখা গেছে, ৮৬ শতাংশ প্রি-স্কুল শিশু স্মার্টফোনে আসক্ত, যার মধ্যে ২৯ শতাংশ অনেক বেশি সময় মোবাইল ফোনে ভিডিও দেখে। তারা গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৩ ঘণ্টা স্মার্টফোন ব্যবহার করে, যা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ করা সময়ের তিনগুণ। এর মধ্যে ৯২ শতাংশ শিশু মা-বাবার ফোন ব্যবহার করে, আর মাত্র ৮ শতাংশ শিশুর নিজস্ব ফোন আছে। কিন্তু মাত্র ১৪ শতাংশ শিশু স্মার্টফোন ব্যবহার করে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে।
বিশ্বব্যাপী চিত্রও তেমনই উদ্বেগজনক। ইউনিসেফ জানায়, পৃথিবীতে প্রতি তিনজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একজন শিশু। ইউরোপীয় গবেষণা অনুযায়ী, ৯ থেকে ১৬ বছর বয়সী ৮০ শতাংশ শিশু প্রতিদিন স্মার্টফোন ব্যবহার করে এবং প্রায় প্রতিদিনই অনলাইনে থাকে। গড়ে একজন মানুষ প্রতিদিন প্রায় ৭ ঘণ্টা স্ক্রিনের সামনে থাকে। বাংলাদেশে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বহু কিশোর-কিশোরী দিনে ৫-৬ ঘণ্টা স্ক্রিনে সময় কাটায়, যার বড় অংশ সোশ্যাল মিডিয়া ও ইউটিউবে কনটেন্ট দেখে থাকে।
বিজ্ঞাপন আয়ের দিক থেকেও শিশু-কিশোররা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর বড় লক্ষ্য। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা অনুসারে, ২০২২ সালে ইউটিউব ১২ বছর ও তার কম বয়সী ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞাপন আয় করেছেÑ ৯৫৯ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার। এরপর ইনস্টাগ্রাম (৮০১ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার) এবং ফেসবুক (১৩৭ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার)।
১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী কিশোরদের কাছ থেকে ইনস্টাগ্রাম সর্বোচ্চ আয় করেছে. প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার, এরপর টিকটক (২ বিলিয়ন ডলার) এবং ইউটিউব (১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার)। অনুমান অনুযায়ী, ২০২২ সালে স্ন্যাপচ্যাটের মোট বিজ্ঞাপন আয়ের ৪১ শতাংশ এসেছে ১৮ বছরের কম বয়সীদের থেকে। টিকটক ৩৫ শতাংশ, ইউটিউব ২৭ শতাংশ এবং ইনস্টাগ্রাম ১৬ শতাংশ আয় করেছে এ বয়সসীমার ব্যবহারকারীদের থেকে।
বিশেষ করে ইউটিউবে শিশুদের উপস্থিতি এবং বিজ্ঞাপন গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২ থেকে ১২ বছর বয়সী প্রায় ৭০ শতাংশ শিশু স¤প্রতি ইউটিউবে বিজ্ঞাপন দেখেছে, যা টেলিভিশনের তুলনায় অনেক বেশি।
এ বিষয়ে পুষ্প নামের এক নারী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমি একটি হাসপাতালে রিসিপশনিস্ট হিসেবে কাজ করি। স্বামী দেশের বাইরে থাকেন, তাই সন্তানের দেখাশোনার দায়িত্ব একাই সামলাতে হয়। আমার মেয়ের বয়স ১০ বছর। স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। সকালে স্কুলে দিয়ে আমি কাজে যাই, আর সে স্কুল শেষে একা বাসায় ফেরে। রুমে একা থাকতে ভয় পায় বলে বাধ্য হয়ে তাকে একটি মোবাইল দিয়ে যাই। যেদিন বিকালে ডিউটি থাকে, সেদিন সঙ্গে নিয়ে যাই। ডিউটির সময় বিরক্ত করলে হাতে ফোন ধরিয়ে দিই। এতে আমার কাজ চালাতে সুবিধা হয়।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় শিশুদের পক্ষে ভিডিও দেখা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৭৫ শতাংশ মানুষ দিনে অন্তত একবার ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে গ্রামে ইন্টারনেট ব্যবহারের হার ছিল ৪৮ দশমিক ২ শতাংশ এবং শহরে ৬১ দশমিক ৬ শতাংশ ।
প্রাপ্ত তথ্যে আরও দেখা যায়, ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩ কোটি ৩৬ লাখ ১০ হাজার। এর মধ্যে ১১ কোটি ৯২ লাখ ২৯ হাজার মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী।
আবার মোবাইল ফোন রয়েছে দেশের ৯৮ দশমিক ৭ শতাংশ পরিবারের কাছে, যার মধ্যে ৭২ দশমিক ৩ শতাংশ পরিবারের কাছে রয়েছে এক বা একাধিক স্মার্টফোন।
মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের (অ্যামটব) হিসাব বলছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ১৯ কোটি ১৩ লাখ ৮০ হাজার সিম ব্যবহারকারী ছিল। ওই বছর দেশে প্রায় ৫২ শতাংশ মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করত, যার মধ্যে শহরে ৪১ শতাংশ ও গ্রামে ২৬ শতাংশ। ২০২৪ ও ২০২৫ সালে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ৫৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে এবং ৩০ দশমিক ৬৮ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, ৫ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী ছেলেশিশুদের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৩৮ দশমিক ০২ শতাংশ এবং মেয়েশিশুদের মধ্যে ২৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। অন্যদিকে ১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৪৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ পুরুষ এবং ২৮ দশমিক ০৯ শতাংশ নারী ইন্টারনেট ব্যবহার করে।
জার্মানিভিত্তিক ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি বোম্বাস্টিং কমিউনিকেশনের উদ্যোক্তা মীর রাকীব-উন-নবী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমাদের ক্লাইন্টরা শিশুদের পছন্দের গেমের ভিডিও কনটেন্টে তৈরি করে তাদের বিজ্ঞাপন প্রচার করে। বাচ্চাদের এ ধরনের বিজ্ঞাপন কনটেন্ট এর কাজ বেশিরভাগ পায় অ্যানিমেশন ভিডিও নিয়ে কাজ করা এজেন্সিগুলো।’

Discussion about this post