প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

স্বাধীনতা-উত্তর সংস্কৃতির জিজ্ঞাসা

 

মিজানুর রহমান শেলী: ম্যাট্রিকুলেশন পাস করলে আগের দিনে সাত গ্রামের লোক তাকে দেখতে আসতো। একটি বই কেনা হলে, গ্রামের বিভিন্ন হাতে তা ঘুরতো। আবার গ্রামের যে কোনো শিক্ষকই ছিলেন নীতি, জ্ঞান ও বোধের প্রতীক—সম্মানে তিনি থাকতেন সবার ওপরে। সেই সংস্কৃতি আজ নেই। তবে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বেড়েছে। জ্ঞানের কদর তাহলে কি ম্রিয়মাণ হয়েছে? মানুষ আজ বড় আত্মকেন্দ্রিক। হিন্দু-মুসলিম, নারী-পুরুষ, কালো-সাদা ভেদে মানবিকতার রেওয়াজ এ বাংলায় ছিল। কিন্তু এ মানবিকতা বা মানবসেবা কোথায় হারিয়ে গেলো? এর উত্তর কেবল গণমানুষের কাছে চেয়ে লাভ হবে না। বরং সাংস্কৃতিক সচেতনতার মৃত্যুপথেই এর জবাব লুকিয়ে আছে।

পাকিস্তান ও ভারত দুটি রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল। এর ভিত্তি ছিল দ্বিজাতি তত্ত্ব। একটি মুসলিম আরেকটি জাতিতে হিন্দু। তবুও ভারত ও পাকিস্তানের রাজনীতি কোনোটাই হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতে আবর্তিত হয়নি। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতিতে মুসলিম জাতির স্বার্থই কেবল মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলে ধর্মকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের অখণ্ডতা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। বরং মুসলিম জাতির স্বার্থ ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে থাকে। এ সময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে জাতি-সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ঔপনিবেশিক রূপ লাভের উপক্রম হয়।

ইউরোপীয় উপনিবেশের ভেতর দিয়ে যে জ্ঞান-ক্ষমতার চর্চা শুরু হয়েছিল, তা পরবর্তী সময়ে যেন পশ্চিম পাকিস্তানিরাও পূর্ব পাকিস্তানে আরোপ করতে শুরু করে। কেননা, সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানিরা শিক্ষা-দীক্ষায় পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে পিছিয়ে থাকায়, রাজনীতিতে পশ্চিম পাকিস্তানিরাই ছিল এগিয়ে। এ সুযোগে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ইউরোপের প্রাচ্যবাদী দৃষ্টির মতো এক ঔপনিবেশিক দৃষ্টি পূর্ব পাকিস্তানে প্রয়োগ করতে শুরু করে। সে দৃষ্টিতে ছিল জ্ঞানের সঙ্গে ক্ষমতা, বিদ্যার সঙ্গে রাজনীতি, পাণ্ডিত্যের সঙ্গে প্রভুত্ব। এ দৃষ্টিতেই ব্রিটিশরা প্রাচ্যকে দেখেছিল, তবে প্রাচ্যের চোখে নয়; বরং নিজেদের চোখে। তার মাত্রা এমন ছিল, যে কোনো প্রাচ্যভ্রমণকারীকে ওরিয়েন্টালিস্ট বলে অ্যাখ্যা দিত তারা। পাকিস্তানিরাও এ বাংলাকে নিজেদের চোখে দেখতে চেয়েছিল। তাই সর্বপ্রথম মুখের ভাষাকেই কেড়ে নিতে চায়। কিন্তু তত দিনে পূর্ব পাকিস্তানে জাতি-সচেতনতা ও সাংস্কৃতিক অধিকারবোধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে জমে ওঠে, তা অবশ্য পাকিস্তানিরা আঁচ করে উঠতে পারেনি। তাই প্রথম আক্রমণেই তারা ধরাশায়ী হয়। দিন দিন ভাষা, শিল্পকলা, কৃষ্টি, রীতি-আচার ও বোধ দেশের শিক্ষিত সমাজে আরও বেশি দানা বাঁধতে থাকে। তখনই তারা পশ্চিম পাকিস্তানের কাছ থেকে নিজেদের অধিকার আদায় করার সংগ্রাম চালায়। এ সংগ্রাম চূড়ান্ত রূপই ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধ। মোদ্দাকথা হলো, ধর্ম ইসলাম নয়, বরং মুসলিম জাতিবোধের জায়গা থেকে পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও, পূর্ব পাকিস্তানিরা নিজেদের জাতিগত ঐতিহ্য, স্বার্থ ও রুচি হারানোর আশঙ্কা করেছিল জাতিসচেতনতা আর সাংস্কৃতিক অধিকারবোধের জায়গা থেকে। কিন্তু স্বাধীনতার পরের ৪৫ বছরে আমরা আমাদের জাতি-সাংস্কৃতিক সচেতনতা কতটুকু অক্ষুণ্ন রাখতে পেরেছি? এ প্রশ্ন আজ প্রাসঙ্গিক। এর জবাব না পেলে স্বাধীনতার মূল্য হারাতে হয়।

এখানে শিক্ষার বিষয়টি সবার আগে চলে আসে। কেননা, বায়ান্ন থেকে একাত্তরের পরিপ্রেক্ষিত বিচার করলে দেখা যায়, তখন যে জাতি-সাংস্কৃতিক সচেতনতা সৃষ্টি হলো তার মূল ভিত্তি ছিল শিক্ষা। অথচ গত ৪৫ বছরে আমরা তার কতটুকু লালন করেছি? ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে শিক্ষার হার ছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, বর্তমানে শিক্ষার এ হার ৭০ শতাংশ। অর্থাৎ ৪৫ বছরে দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে ৫৩ শতাংশ। সংখ্যার হিসাবে এ চিত্রটিকে মোটামুটি ভালো বলা গেলেও শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কথাটি রাষ্ট্রপতি গত বছর অনুষ্ঠিত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে দেওয়া ভাষণে স্বীকার করেছেন।

জাতি-সাংস্কৃতিক সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়োজনে শিক্ষাকে হতে হয় এক বিশেষ রূপসম্পন্ন। বলা চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেবল জ্ঞানের লেনদেন করেই কাজ শেষ করলে চলে না। অবশ্যই আহরিত জ্ঞান থেকে শিক্ষা লাভ করাটা জরুরি। তা না-হলে মূল্যবোধের অবক্ষয় সেখান থেকেই শুরু হয়। তাছাড়া শিক্ষায় যেসব পাঠ্য নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে প্রাণবন্ত করে, সেই পাঠ্য গুরুত্ববাহী হওয়া উচিত। আবার বিশ্ববিদ্যালয় কেবল পাঠদান আর গ্রহণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। জ্ঞান সৃষ্টি এখান থেকেই করতে হয়। অথচ গত ৪৫ বছরে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আশানুরূপ গবেষণা হয়নি। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই মূল্যবোধের সবচেয়ে বড় অবক্ষয়ের চিত্র স্পষ্ট হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এর প্রথম লক্ষণ দেখা যায় অস্থিরতা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। অস্থিরতার প্রধান কারণ রাজনীতি। যদিও রাজনীতিই রাষ্ট্র পরিচালনার মুখ্য ব্যাকরণ। তবে আজকের রাজনীতির সঙ্গে রাষ্ট্র-সচেতনতার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। অধ্যাপক খালেদুজ্জামানের গবেষণায় দেখা গেছে, ৫২ দশমিক ৮৭ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ অস্থিরতার জন্য ছাত্ররাজনীতি দায়ী। অন্যদিকে শিক্ষকরাজনীতিকে দায়ী করেছে ১২ দশমিক এক শতাংশ শিক্ষার্থী। তবে এ কথা সত্য, ছাত্ররাজনীতি ও শিক্ষকরাজনীতিকে এখন আর আলাদা করে দেখার কিছু নেই। দুটোই এক অনাকাঙ্ক্ষিত মিথষ্ক্রিয়ায় চলমান। এই দুই রাজনীতির ফলাফল হিসেবে আরেকটি সংকটের জন্ম নেয়, তা হলো সেশনজট। ২৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন, সেশন জ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিরতার কারণ। অন্যদিকে ৩৮.৯ শতাংশ শিক্ষক এ অস্থিরতার জন্য ছাত্ররাজনীতিকে দায়ী করেন। ২৫ শতাংশ শিক্ষক দায়ী করেন শিক্ষকরাজনীতিকে। তবে শিক্ষকদের মতামতে ১১.১২ শতাংশ কারণ হিসেবে উঠে এসেছে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতার কারণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অস্থিরতার কারণে সৃষ্ট প্রাদুর্ভাব দীর্ঘমেয়াদি ও বিধ্বংসী। ফলে সামগ্রিক মূল্যবোধ নষ্ট হয়। এমনকি জাতির শিক্ষিতগোষ্ঠীর মাধ্যে রাষ্ট্রের প্রতি সম্মান ও দায়বোধ দিন দিন কমে আসে। তারা ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে কেন্দ্র করে মূল্যবোধের চর্চা ভুলে যায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, শিক্ষা-কাঠামোর এ অস্থিরতার কারণে সমাজ-কাঠামোতে নানা রকম দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। ২৫ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, এর ফলে জনমনে আত্মবিশ্বাস শূন্য হয়ে পড়ছে। আর রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সব ধরনের সন্ত্রাস সৃষ্টির পেছনে এ অস্থিরতাকে দায়ী করেন ১৩.৮৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। ইভ টিজিং, ধর্ষণ, প্রতারণা ও ব্যভিচারের মতো নীচু আর ঘৃণ্য অপরাধের পেছনে এ অস্থিরতার যে একটি প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে, তা মনে করেন ১১.১২ শতাংশ শিক্ষক। ভয়ংকর ব্যাপার হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অস্থিরতার কারণে ছিনতাইয়ের মতো নীচু কাজে কিছু শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়ছে, তা মনে করেন ১০০ শতাংশ শিক্ষক। এমনকি ৬১.১২ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন, এ অস্থিরতার প্রকোপে শিক্ষার মানে অধঃগতি নেমে আসছে।

এ চিত্র কি জাতি-সাংস্কৃতিক সচেতনতা সৃষ্টিতে সহায়ক হতে পারে? অবশ্যই নয়। বরং যে যার মতো করে নিজের স্বার্থ উদ্ধারে দেশ ও দশকে বহিঃশক্তির কাছে বিকিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করবে না। এমনকি নিজেরাই নিজেদের পায়ে কুঠারাঘাত করে নিঃশেষ হচ্ছে। বড়ই হতাশ হওয়ার মতো এ দুঃসময়ে, চলমান সংকট মোকাবিলায় কোনো প্রচেষ্টা বা পরিকল্পনা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর রয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে নানাবিধ অরাজকতা চলছে। মেধাবীরা জায়গা পাচ্ছে না। তবে এখানেই শেষ নয়। যারা সনদের জোরে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের সময় মেধাবী বলে দাবি করছে তাদের স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ভালো ফলাফল অর্জন নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে।

শিক্ষা-কাঠামোয় এ অরাজকতা আর দুর্নীতির ফলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েরই নৈতিক স্খলন হচ্ছে। শিক্ষক ছাত্রীকে ধর্ষণ করছে বা তার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলছে, এ কথা অজানা বা পুরোনো নয়। ইউএন উইমেনের সহায়তায় বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির এক জরিপে দেখা গেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে হাইকোর্টের নির্দেশনা সম্পর্কে ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী কিছু জানেন না। স্বায়ত্তশাসিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন, যৌন হয়রানি প্রতিরোধে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর মতে, এসব প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির বেশিরভাগ ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে না। এমনকি যৌন নির্যাতনের ঘটনাকে এখনও বড় ঘটনা বা অপরাধ হিসেবেই ভাবা হচ্ছে না। এ প্রকোপ কেবল বিশ্ববিদ্যালয়জুড়েই নয়, প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আঁকড়ে ধরেছে। ৩০ আগস্ট ২০১৫ দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকায় প্রকাশ হয়, দ্বাদশ শ্রেণির এক ছাত্রীর (১৮) নাম যুক্ত করে রায়হান আলী নামে এক বখাটে যুবক বিভিন্ন কম্পিউটার, টেলিকমে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি প্রচার করে ওই ছাত্রীকে কুপ্রস্তাব দেয়। ২০১৫ সালে এ রকম ৪৯টি ঘটনা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে (বিএনডব্লিউএলএ)। এ চিত্র আজ গ্রামগঞ্জে, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব শ্রেণির যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে আছড়ে পড়ছে। ২০১৫ সালে, ঢাকার মুগদাতে এক স্টুডিও মালিক ও শিশুসাহিত্যিক পথশিশু ধরে এনে পর্নো বানিয়ে বিদেশে বিক্রি করতো। তার মাসিক আয় ছিল ১০ লাখ টাকা। পুলিশের তথ্যানুসারে, সারা দেশে ২০১৫ সালে নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে গড়ে প্রতিদিন ৫৮টি। আরও অনেক ঘটনার মামলা হয় না। তা মহাকালে গল্প হিসেবে সংরক্ষিত হয়!

এ বিধুরবিদারী গল্প নিয়ে দেশের সাংস্কৃতিক উন্নয়নসহ কোনো ধরনের উন্নয়ন সম্ভব হতে পারে না। মূল্যের অবক্ষয়ে কীভাবে সমাজের উন্নয়ন হতে পারে? শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সের হাতে আজ বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস ডিভাইস। তাতে ইন্টারনেট সংযোগ সহজলভ্য, এটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের দেশি-বিদেশি পর্নো সাইটে সহজপ্রবেশ্য এবং কিছু নিউজপোর্টালে অশ্লীলতার বিজ্ঞাপন সহজেই সব শ্রেণি, বয়স ও শিক্ষার মানুষকে প্রলুব্ধ করছে। তারা আকৃষ্ট এবং অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। ফলে তাদের বিবেক ও নৈতিকতা বোধ ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় সুদৃষ্টি থাকলে এর সহজ সমাধান হতে পারে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরে ও বাইরে যুবসমাজের এ অধঃগতি কেবল জীবনাচরণেই নয়, বরং তার চিন্তা ও চৈতন্যে মিশে যাচ্ছে। এমনকি কখনও বা শিক্ষায় চৈতন্যের চেনামুখ অচেনা হয়ে যায়। অপরাজনীতির কালো প্রভাব আরও কালচে করে তোলে শিক্ষা, চিন্তা ও শিক্ষার্থীর মন। শিল্প-সাহিত্য শিক্ষার এমন এক মাধ্যম যেখানে চৈতন্যকে সামাজিক দায়বোধের জায়গায় ঋদ্ধ করে তোলে। সেই জায়গাটি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে।

শিল্পী জয়নুলের শিল্প-আন্দোলনে যে মাটি ছিল, তা অপদ্রব্যে মলিন হয়েছে এ বাংলাদেশেই। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্ম হয়েছিল একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। সেই মুসলিম সমাজে ছবি আঁকা ছিল গর্হিত কাজ, অথবা নিশ্চেষ্ট বলা চলে। পরিবারের কোনো বাধা-বিপত্তি ছাড়াই তিনি এ পথে শক্ত পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার ছবিতে দেশ আর দশের জীবনাচার খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে দেশে ফিরে তার ছাত্রদের দেশকে জেনে, শিখে এবং ধারণ করার পর বিদেশ যেতে উপদেশ দিয়েছিলেন। কেননা দেশ না জেনে বিদেশ গিয়ে আপন সত্তা হারিয়ে নিদারুণ পরিণতি ভোগ করা অনেক দেশিকে তিনি দেখেছিলেন, খুব কাছে থেকে। তবে তিনি বিদেশ-বিভুইয়ে দেশের ছবিই উপস্থাপন করেছেন সর্বদা। শিল্পী জয়নুল প্রচ্ছদ আঁকতেন কবি জসীমউদ্দীনের কবিতার বইয়ে। কবির কবিতা আর চিত্রকরের চিত্রে কেবলই দেশের মানুষের প্রাণ সঞ্চারিত হয়েছে সেকালে। জয়নুলের দুর্ভিক্ষের চিত্রগুলো সাদামাটা হলদে কাগজে সাধারণ কিছু রেখা। কিন্তু ওই রেখায় যে মাটি ছিল, তা শিল্পী কামরুল হাসান পাশে পাশে শিষ্যের বেশে তখন ঘুরে ঘুরেও বুঝতে পারেননি। অবশেষে বোঝা গেল, ওই ছবিতে ছিল অহিংস প্রতিবাদ; ছিল এমন রাগ আর বাদ-প্রতিবাদ যা কাল-মহাকাল ছাপিয়ে গেছে। তার এ বোধ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিল শিল্পকলা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ছড়িয়ে পড়েছিল তার চৈতন্য। শিল্পের এ আন্দোলন তাই স্বাধীনতা আন্দোলনেও হয়ে উঠেছিল একীভূত-অপ্রতিরোধ্য। প্রথম প্ল্যাকার্ড তৈরি হয়েছিল ‘স্বাধীনতা’। স্বাধীনতার পরে শিল্প-সাহিত্যের এ হালচাল বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৮০ থেকে ৯০ সালের মধ্যে চারুকলায় শিল্পীদের ক্যানভাসে বিমূর্ত ছবি ভেসে উঠেছে। তবে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে আবার বিমূর্ত ভেঙে মূর্ত ছবির চর্চা শুরু হয়। তবে সেই মূর্তমান চিত্রে দেশের পরিচয় সব সময় পাওয়া গেছে, তা বলা চলে না। আবার, জসীমউদ্দীনের কবিতার মতো করে এত দেশের মায়া আর প্রাণের ছোঁয়া কোনো কবিতায়-সাহিত্যে ছড়ায়নি। ‘শিল্পকলার জন্য শিল্পকলা’ এ তত্ত্বকথাকে জয়নুল বিশ্বাস করেননি। তিনি নিজ ও সমাজের জন্য ছবি আঁকতেন। অবশ্য স্বাধীনতার পর ‘শিল্পকলার জন্য শিল্পকলা’র মতো বিভিন্ন ধাঁচে শিল্প-সাহিত্যের চর্চা শুরু হলো। ফলে জসীমউদ্দীনের মাঠ-ঘাট আর জয়নুলের লোকশিল্পের মায়া সবই নিদাঘ হয়ে গেল।

সেই মাটির শিল্প-সাহিত্য যেমন আজ মলিন। তেমনি ইতিহাস, ঐতিহ্যের চর্চা এ দেশে আজ খুবই নাজুক। গবেষণা খাতে তেমন বেশি লগ্নি হতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে জ্ঞান থেকে আশানুরূপ জ্ঞান উৎপাদন হচ্ছে না। শিক্ষা হলো নাগরিকের মৌলিক অধিকার। এটা একটি সেবা খাত। শিক্ষার মতো আরও অন্য সেবা খাত আজ পণ্যে পরিণত হয়েছে। যেমন—ব্যাংক, হাসপাতাল, যোগাযোগ ইত্যাদি। ব্যাংক ও হাসপাতালের সরকারি সেবা ব্যর্থ হয়েছে। তখনই দেশে বেসরকারি খাত লাভজনক অবস্থায় আছে এবং কখনও বা দেশের স্বার্থ ভূলুণ্ঠিত হওয়ার প্রমাণ মিলছে। সাম্প্রতিক ব্যাংকব্যবস্থার কেলেঙ্কারি তার প্রমাণ। বেসরকারি হাসপাতাল মানুষকে যেন জিম্মি দশায় আটকে ফেলেছে। সরকারি হাসপাতালের ওপরও মানুষের আস্থা নেই। একইভাবে দেশের সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যর্থ প্রমাণের প্রক্রিয়াই যেন চলছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষাসেবাকে পণ্যে রূপ দিয়েছে। আর এসব সম্ভব হয়েছে গ্যাটস (GATS) চুক্তির মাধ্যমে। এটা হলো সেবা খাতে বাণিজ্যবিষয়ক চুক্তি। (TRIPS) ও (TRIMS)  চুক্তির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেই ফাঁদে পা দিয়েছে। এ বিষয়ে অরূপ রাহী তার ‘কার লাভ কার ক্ষতি’ বইয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এভাবে শিক্ষা পণ্যে রূপান্তরিত হলে সেই শিক্ষা জাতি-সাংস্কৃতিক সচেতনতা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হবেই হবে। পশ্চিমের প্রাচ্যবাদী চোখ আবারও আমাদের শাসন ও শোষণ করবে। তখন ‘শিক্ষিত’ মানুষরা নিজেদের জাতি-সাংস্কৃতিক সচেতনতার কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবে না। কেননা সেই চৈতন্য তাদের থাকবে না। এ যেন শিক্ষাই অশিক্ষা।

তাই স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সংস্কৃতি নিয়ে আজ অনেক জিজ্ঞাসা উপস্থিত হয়েছে। বলা চলে, এসব কর্তাব্যক্তিদের চোখের সামনেই প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। এমনকি দৃশ্যটা এতই শোচনীয় যে কর্তাব্যক্তিদের হাতেই এসবের উদয় ও বিস্তার হচ্ছে, তা বলা চলে। অবশ্য এ ব্যাপারে তেমন কোনো নথি দেখানো যাবে না। তবে বহুকাল অবধি যেহেতু এসব অনাসৃষ্টি অবলীলায় চলছে, তাই তারা দায় এড়াতে পারেন না। তাই রাষ্ট্র-কাঠামো যদি দেশের সার্বভৌমত্ব আর স্বকীয়তার কথা মাথায় রেখে আশু পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন, তবে ধীরে ধীরে এই ঘা ও ব্যথা নিরসন হবে। সে প্রত্যয় আমাদের রয়েছে।

লেখক: গবেষক