বিশিষ্ট দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব (জিসি দেব) ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে হত্যার শিকার হন। এদিন বিকালে জগন্নাথ হলের ভেতরে গর্ত খুঁড়ে মাটি চাপা দেয়া হয় হলের প্রভোস্ট ড. গোবিন্দচন্দ্র দেবসহ অন্যদের মৃতদেহ। একই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাষক অণুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য ও শহীদুল্লাহ্ হলের দুজন আবাসিক শিক্ষক আতাউর রহমান খান খাদিম (পদার্থ বিজ্ঞান), গণিত বিভাগের শিক্ষক শরাফত আলী-সহ শহীদুল্লাহ্ হলের নাম না জানা অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী এদিন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে হত্যার শিকার হন। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব চিন্তাচেতনায় ছিলেন সক্রেটিসের ভাবশিষ্য। অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী দার্শনিক দেব সব ধর্মকে দেখেছেন উদার ও সর্বজনীন দৃষ্টিকোণ থেকে। তার চিন্তাধারার মূলে কাজ করেছে বিশ্বজনীন মানবপ্রেম, সাম্য ও মৈত্রী। তার দর্শন সমন্বয়ী ভাববাদ বা সিনথেটিক আইডিয়ালিজম নামে সমধিক পরিচিত। দর্শনে বিশিষ্ট অবদানের জন্য ১৯৬৭ সালে তিনি সম্মানসূচক ‘দর্শনসাগর’ উপাধিতে ভূষিত হন। গোবিন্দ চন্দ্র দেব ১৯০৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সিলেট জেলার বিয়ানী বাজারের লাউতা গ্রামে জš§গ্রহণ করেন। তার আসল নাম গোবিন্দচন্দ্র দেব পুরকায়স্থ। ১৯২৯ সালে তিনি কলকাতার সংস্কৃত কলেজ থেকে দর্শন বিষয়ে বিএ (সম্মান) এবং ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করে অধ্যাপনায় যোগ দেন। অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি ‘রিজন, ইনটুইশন অ্যান্ড রিয়ালিটি’ নামক অভিসন্দর্ভ রচনা করে ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। জিসি দেব দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে কিছুকাল অধ্যাপনা করে ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। গোবিন্দচন্দ্র দেব প্রকাশিত মোট গ্রন্থ ৯টি, যার মধ্যে জীবদ্দশায় সাতটি এবং মৃত্যুর পরে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৫ সালে ড. দেবকে ‘একুশে পদক’ এবং ২০০৮ সালে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রদান করে। ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে তার স্মরণে গোবিন্দ দেব দর্শন গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিনি মানবকল্যাণ সাধনায়, মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে এবং অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী দর্শন প্রচারের জন্য তার সব সম্পত্তি ও অর্থ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে গেছেন।
কাজী সালমা সুলতানা