চার্লি চ্যাপলিনের পুরো শিল্পীজীবনটাই হচ্ছে পৃথিবীতে মানবতাকে প্রতিষ্ঠিত করার এক বিরাট সংগ্রামের সুসংবদ্ধ ইতিহাস যে সংগ্রামকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন বাস্তবে।
মৃণাল সেন
স্যার চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন জুনিয়র চার্লি চ্যাপলিন নামেই বেশি পরিচিত। এই ব্রিটিশ চলচ্চিত্র অভিনেতা হলিউড সিনেমার প্রথম থেকে মধ্যকালের বিখ্যাত শিল্পীদের অন্যতম। চ্যাপলিন পৃথিবী বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালকও বটে। চ্যাপলিনকে চলচ্চিত্রের পর্দায় শ্রেষ্ঠতম মূকাভিনেতা ও কৌতুকাভিনেতাদের একজন বলেও মনে করা হয়। চলচ্চিত্র শিল্পজগতে চ্যাপলিনের প্রভাব অনস্বীকার্য।
নির্বাক চলচ্চিত্র যুগের অন্যতম মৌলিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব চ্যাপলিন নিজের ছবিতে নিজেই অভিনয়, সংলাপ রচনা, পরিচালনা, প্রযোজনা, এমন কি সংগীত পরিচালনা পর্যন্ত করেছেন। শিশুশিল্পী হিসেবে ইংল্যান্ডের ভিক্টোরিয়ান নাট্যমঞ্চ ও মিউজিক হলে সূচিত চ্যাপলিনের ৬৫ বছরের কর্মজীবনের শেষ হয় ৮৮ বছর বয়সে তার মৃত্যুতে।
চ্যাপলিন অভিনীত মুখ্য চরিত্র তার নিজের সৃষ্ট ভবঘুরে দ্য ট্রাম্প (১৯১৪)। ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, পর্তুগালে ‘শার্লট’ নামে পরিচিত চ্যাপলিনের ট্রাম্প ভবঘুরে হলেও ব্রিটিশ ভদ্রজনোচিত আদব-কায়দায় সুসংস্কৃত ও সম্মানবোধে অটুট। শার্লটের পরনে চাপা কোট, সাইজে বড় প্যান্ট, বড় জুতো, মাথায় বাউলার হ্যাট, হাতে ছড়ি আর একমেবাদ্বিতীয়ম টুথব্রাশ গোঁফ। চ্যাপলিনের বর্ণময় ব্যক্তিজীবন তথা সমাজজীবন খ্যাতি-বিতর্ক দুইয়েরই নিন্ম থেকে শীর্ষবিন্দু ছুঁয়ে গেছে। স্যার চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন ১৮৮৯ সালের ১৬ এপ্রিল লন্ডনের ইস্ট স্ট্রিট ওয়ালওয়ার্থে জন্মগ্রহণ করেন। চার্লি চ্যাপলিনের কোনো বৈধ জন্ম প্রমাণপত্র পাওয়া যায়নি, তাই তার জন্ম নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। সংবাদমাধ্যম নানা সময় নানা রকম তথ্য দিয়েছে তার জন্মস্থান সম্পর্কে। এমনকি তার চলচ্চিত্র জীবনের প্রথমদিকে চ্যাপলিন নিজেও একবার বলেছেন, তিনি ফ্রান্সের ফঁতেউব্ল শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ১৮৯১ সালের আদমশুমারি থেকে জানা যায়, চার্লি তার মা হান্নাহ চ্যাপলিন এবং ভাই সিডনির সঙ্গে দক্ষিণ লন্ডনের ওয়ালওয়ার্থের বার্লো স্ট্রিটে থাকতেন, এটি কেনিংটন জেলার অন্তর্গত। ইতোমধ্যে বাবা চার্লস চ্যাপলিন জুনিয়রের সঙ্গে তার মায়ের বিয়েবিচ্ছেদ ঘটে। চ্যাপলিনের শৈশব কাটে প্রচণ্ড দারিদ্র্য আর কষ্টের মাঝে। আর তাই হয়তো তিনি উপলব্ধি করতেন দেওয়া ও পাওয়াতে কী আনন্দ! তিনি প্রায়ই বলতেন, বৃষ্টিতে হাঁটা খুবই ভালো, কারণ এই সময় কেউ তোমার চোখের জল দেখতে পায় না। অত্যধিক দারিদ্র্যই চ্যাপলিনকে শিশু বয়সেই অভিনয়ের দিকে ঠেলে দেয়। তার মা-বাবা দুজনেই মঞ্চের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তাই এই পেশায় আসাটাই তার কাছে সহজ ছিল। চ্যাপলিন সে সময়ের জনপ্রিয় লোকদল ‘জ্যাকসন্স এইট ল্যাংকাশায়ার ল্যাডস’-এর সদস্য হিসেবে নানা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। এরপর ১৪ বছর বয়সে তিনি উইলিয়াম জিলেট অভিনীত শার্লক হোমস নাটকে কাগজ বিলিওয়ালার চরিত্রে অভিনয় করেন। সে সুবাদে তিনি ব্রিটেনের নানা প্রদেশ ভ্রমণ করেন এবং অভিনেতা হিসেবে তিনি যে খুবই সম্ভাবনাময় তা সবাইকে জানিয়ে দেন।
চার্লি চ্যাপলিনের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র: মেকিং অব লিভিং (১৯১৪), দ্য ট্রাম্প (১৯১৪), কিড অটো রেসেস অ্যাট ভেনিস (১৯১৫), এ ডগস লাইফ (১৯১৭), শোলডার আর্মস (১৯১৮), দ্য কিড (১৯২১), দ্য সার্কাস (১৯২৬), সিটি লাইটস (১৯৩১), মডার্ন টাইমস (১৯৩৬), দ্য গ্রেট ডিকটেটর (১৯৪০), মঁসিয়ে ভের্দু (১৯৪৭), দ্য গোল্ড রাশ (১৯২৫), লাইম লাইট (১৯৫২), এ কিং অব নিউইর্য়ক (১৯৫৭), এ কাউন্টেস ফ্রম হংকং (১৯৬৭) প্রভৃতি।
রচিত গ্রন্থ: মাই অটোবায়োগ্রাফি, মাই লাইফ ইন পিকচারস।
প্রাসঙ্গিক গ্রন্থ: থিয়োডোর হাফের ‘চার্লি চ্যাপলিন’, সের্গেই আইনস্টাইনের ‘চার্লি দ্য কিড’, মৃণাল সেনের ‘চার্লি চ্যাপলিন’ প্রভৃতি।
https://www.youtube.com/watch?v=u0IU8uQniX8