মো. হাবিবে মিল্লাত : বিভিন্ন সংক্রামক রোগ নিয়ে আমরা যতটা উদ্বিগ্ন, অসংক্রামক রোগ (এনসিডি) নিয়ে আমরা তার বিপরীত প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করি। অথচ নীরবে প্রতিদিন শুধু অসংক্রামক রোগ দেশে মৃত্যুর সারি দির্ঘায়িত করছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ মৃত্যুর জন্য অসংক্রামক রোগই দায়ী। বিভিন্ন অসংক্রামক রোগ যেমন ক্যানসার, হƒদরোগ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ এবং ডায়াবেটিসের একটি প্রধান কারণ তামাকের ব্যবহার। অসংক্রামক রোগীদের বেশিরভাগই তামাক ও তামাকজাত পণ্য ব্যবহারকারী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বে ৮০ লাখের বেশি মানুষ সরাসরি তামাকজনিত রোগের কারণে মারা যায়, যার মধ্যে শুধু বাংলাদেশেই মারা যায় প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ। অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা অনেক খরচ সাপেক্ষ এবং দীর্ঘমেয়াদি বলে এটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য একটি বড় হুমকি। ধূমপান বা তামাকজাত পণ্য মানব দেহের পুষ্টি জোগানো বা ক্ষুধা নিবারণ তো করেই না উপরন্তু স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় এবং আর্থিক ক্ষতি করে।
ধূমপান ও তামাক নিয়ন্ত্রণে আমাদের ব্যাপক হারে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তবে দুঃখের বিষয় এই যে, সিমেন্ট, সার এবং শিশুর খাদ্যের সঙ্গে সিগারেটও ১৯৫৬ সালে প্রণীত ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইনের’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল যেটি এখনও রয়েছে। ধূমপানের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমাতে অবিলম্বে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে সিগারেটকে বাদ দিতে হবে। ‘গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (জিএটিএস)) ২০১৭’-এর তথ্যমতে বাংলাদেশের ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাকজাত পণ্য ব্যবহার করে। ধূমপায়ীর সংখ্যা হ্রাসের পাশাপাশি আমাদের নতুন ধূমপায়ী তৈরি প্রতিহত করতে হবে। ‘গ্লোবাল ইয়ু থ টোব্যাকো সার্ভে (জিওয়াইটিএস) ২০১৩’ বলছে, দেশের প্রায় ৭ শতাংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু-কিশোর তামাক সেবন করে, যাদের বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে কোনো প্রকার ধূমপান ও তামাকজাত পণ্য বিক্রি বন্ধ করতে হবে। অপ্রাপ্তবয়স্করা যাতে ধূমপানের প্রতি আগ্রহী না হয় সেজন্য প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি পরিবারের সদস্য এবং ধর্মীয় ব্যক্তিদেরও এই বিষয়ে সবার বিশেষ করে তরুণদের সচেতন করতে হবে।
ধূমপায়ী তৈরিতে তামাক কোম্পানিগুলো যে কৌশলগুলো ব্যবহার করে তার মধ্যে একটি হলো তাদের পণ্যগুলোকে এমন দেশে বাজারজাত করা যেখানে তামাক বিজ্ঞাপনের ওপর কম বিধিনিষেধ রয়েছে এবং পাবলিক প্লেসে ধূমপানের ওপর কম নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তারা অপ্রাপ্ত বয়স্কদের লক্ষ্য করে তাদের বিজ্ঞাপনী প্রচারাভিযানের মাধ্যমে আজীবন গ্রাহক তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, তামাক কোম্পানিগুলো তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে মিথ্যা ও ভুল তথ্য সরবরাহ করে জনগণকে বিভ্রান্ত করে এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দুর্বল করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, তারা তামাকজাত পণ্যের ওপর উচ্চ করারোপ এবং তামাক আইন সংশোধনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাদের মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। সামগ্রিকভাবে, যদিও তামাক কোম্পানিগুলো প্রথাগত অর্থে উপনিবেশ স্থাপন করছে না, কিন্তু তাদের ক্রিয়াকলাপ বিশ্বের অনেক অংশের মতো বাংলাদেশেও জনস্বাস্থ্য এবং মানুষের আর্থিক ক্ষমতার ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বর্তমানে নেপাল, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, থাইল্যান্ড, তুরস্কসহ বিশ্বের ৬৭টি দেশ পূর্ণাঙ্গ ধূমপানমুক্ত আইন প্রণয়ন (‘ধূমপানের জন নির্ধারিত স্থান’ রাখার বিধান বাতিলসহ) ও বাস্তবায়ন করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, ২০২০ সাল পর্যন্ত নেপাল, পাকিস্তান, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের ৪৯টি দেশে বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকজাত পণ্য প্রকাশ্যে প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১০৯টি দেশে সিগারেটের ছোট প্যাকেট বা খুচরা শলাকা বিক্রি নিষিদ্ধ হয়েছে। গ্লোবাল সেন্টার ফর গুড গভার্ন্যান্স ইন টোব্যাকো কন্ট্রোলের তথ্যমতে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিশ্বের ৩৭টি দেশে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)-এর অনুচ্ছেদ ১৩ এবং এর নির্দেশিকাগুলোর একটি হচ্ছে তামাকের বিজ্ঞাপন, প্রচার এবং পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধের পাশাপাশি বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকজাত পণ্য প্রকাশ্যে প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা। অনেক দেশে তামাকজাত পণ্য অনলাইনে কেনা যায়, এটিও কার্যকরভাবে তামাকজাত পণ্য প্রকাশ্যে প্রদর্শন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২০ সালের তথ্যমতে নেপাল, মালদ্বীপসহ বিশ্বের ৬৭টি দেশ ইন্টারনেটের মাধ্যমে তামাকের বিক্রয় নিষিদ্ধ করেছে। তাছাড়া, তামাক দেশকে একটি বিরাট হুমকিতে ফেলে দিচ্ছে। ২০১৮ সালের হিসেবে দেখা যায়, বাংলাদেশ তামাকের কারণে বছরে প্রায় ৭ হাজার ৬৬০ কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এ আর্থিক ক্ষতি লাঘব, তামাকের ব্যবহার কমানো এবং তরুণদের মধ্যে তামাক ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে কর বৃদ্ধির মাধ্যমে তামাকপণ্যের মূল্য বাড়ানো। কার্যকরভাবে মূল্যবৃদ্ধি করলে তামাকপণ্যের সহজলভ্যতা হ্রাস পাবে এবং তামাকের ব্যবহার কমবে।
উপরোক্ত বিষয়গুলো মাথায় রেখে ধূমপান ও তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের প্রস্তাবিত খসড়ায় রয়েছে, পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ করা, বিক্রয়স্থলে তামাক দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা, তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, খুচরা বিক্রি বন্ধ করা, সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কতার ওপর জোর দেয়া এবং ই-সিগারেট এবং হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টস (এইচটিপি) নিষিদ্ধ করা। আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসি-তে স্বাক্ষরকারী প্রথম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ ২০০৩ সালে এফসিটিসি-তে স্বাক্ষর করেছে, যেখানে শতভাগ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। তাছাড়া, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার যে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করছেন তা বাস্তবায়নে আমাদের এখনই স্মার্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। এরই লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর ধূমপান ও তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন এবং ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করার জন্য চিঠি দিয়েছেন। পাশাপাশি ১৫২ জন সংসদ সদস্য মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বরাবর তামাক আইন সংশোধনের জন্য চিঠি দিয়েছেন এবং ৮৬ জন সংসদ সদস্য মাননীয় অর্থমন্ত্রী বরাবর সব তামাকপণ্যে সুনির্দিষ্ট করারোপের মাধ্যমে মূল্যবৃদ্ধির জন্য চিঠি দিয়েছেন। দেশের মানুষের জীবন বাঁচাতে এবং রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করতে অবিলম্বে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন সংশোধনের পাশাপাশি তামাক পণ্যে সুনির্দিষ্ট করারোপের মাধ্যমে তামাক পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করে সবার জন্য একটি তামাকমুক্ত এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে।
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিং এবং
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন