ফারুক আলম, লালমনিরহাট: চারদিকে আলুসহ হরেক রকম ফসলের ক্ষেত। আলু ক্ষেতের মাঝখানে এক-আধটা সরষে গাছ। ফুল ও পাতার মধ্যে রাতের জমা শিশির এখনও শুকায়নি। এরই মধ্যে চরের ক্ষেতে কাজে নেমে পড়েছেন সব বয়সী নারী-পুরুষ। তিস্তার ধু-ধু বালিপ্রান্তরে সবুজের সমারোহ। সেই তিস্তা, যার সবকিছু কেড়ে নেয়ার সর্বগ্রাসী ভয়ে দিন পার করেন এসব এলাকার মানুষ। বাকি অর্ধেকটা সময় পরিবারসহ ঘাম, শক্তি ও মমত্ব দিয়ে বালিভেদে অঙ্কুরিত করেন নানা জাতের দেশীয় ও বিদেশি ফসল। চকচকে বালিকে পরিণত করেন সবুজের জীবন্ত কার্পেটে। এসব কৃষকের নেই নির্দিষ্ট জমির সীমানা। এ বছর এদিকে তো সে বছর সেদিকে। কোনো বার কারও জমি জেগে ওঠে, কারও জমি ভাঙনের কারণে অদৃশ্য হয়। একবার জমির মালিক, অন্যবার বর্গাচাষি অথবা দিনমজুর। তবুও যুগের পর যুগ বাবা-দাদার দেখানো চাষ পদ্ধতি অবলম্বন করছেন। ফলাচ্ছেন তরমুজ, মিষ্টিকুমড়া, ভুট্টা, আলু, বাদাম, পেঁয়াজ, গম, সরষে ছাড়াও সবজি ও মসলাজাতীয় ফসল। বাদ যায়নি একটু পলি জমা জমিতে বোরো চাষ।
কৃষি দপ্তর বলছে, লালমনিরহাটে চরকেন্দ্রিক আট হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ভুট্টার পরিমাণ সব থেকে বেশি।
উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছর মিষ্টিকুমড়া চাষে বিঘাপ্রতি ৬০ হাজার টাকা আয় করেছেন। ভুট্টা বিঘায় ৫০ মণ পর্যন্ত হচ্ছে। আলু হচ্ছে ১২০ মণের বেশি। এ বাদে আগাম জাতের ফসল চাষে ভারী হচ্ছে কৃষকদের আয়ের অঙ্ক। সাফল্য দেখিয়েছেন চিয়া সিড-সহ সব রকম দেশি ও বিদেশি ফসল চাষে। এরই মধ্যে গত দুই বছরে জেলায় পোলট্রি ফিডসহ বেশ কিছু বহুজাতিক কোম্পানি তাদের ক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চরে উৎপাদিত ফসলের বাজারমূল্য ৪০০ কোটি টাকার বেশি। এর বাইরে ছোট ছোট জমিতে চাষ করা ফসল তো রয়েছে। তাদের ধারণা সঠিক ও পরিকল্পিত নজরদারিতে লালমনিরহাটের চরের উৎপাদিত ফসল হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
এই সম্ভাবনাময় প্রকাণ্ড চর দিনকে দিন বেহাত হচ্ছে। তৈরি হয়েছে সড়ক, অপরিকল্পিত বাজারঘাট, বাড়ি, প্রতিষ্ঠান, বহুজাতিক কোম্পানির দীর্ঘ মেয়াদের প্রকল্প। চরের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের নির্মমতায় অনেকটা স্থবির হতে চলেছে নদীর প্রাকৃতিক রূপ। ইন্ট্রাকো সোলার লিমিটেডসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নদীর গতিপথ পাল্টিয়ে দিয়েছে। নিজেদের ইচ্ছামতো করেছে ব্রিজ-কালভার্ট। যত্রতত্র চলছে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক অবৈধ ড্রেজিং। এমন ধ¡ংসযজ্ঞের মধ্যেও চরের কৃষকরা শুধু কৃষি পরামর্শ বা চরকেন্দ্রিক আধুনিক কৃষির দাবি তুলেছেন।
কৃষকরা জানাচ্ছেন, তারা নিজেদের ইচ্ছামতো চাষাবাদ করছেন। আদিকালের চাষপদ্ধতি তাদের ভরসা। কৃষি কর্মকর্তা বা কোনো পরামর্শক তাদের নেই। সঠিক পরামর্শ সেবা পেলে তাদের উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ অনেক গুণ বেড়ে যাবে।
লালমনিরহাট সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলছেন, তার উপজেলায় ছয়টি চরাঞ্চলে তিন হাজার ৭০০ হাজার হেক্টর চাষযোগ্য জমি রয়েছে। এর মধ্যে ৬০ ভাগ জমি এবার চাষের আওতায় এনেছেন।
আদিতমারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ ওমর ফারুক বলছেন, চর একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা। এখানে সব রকম ফসলই হচ্ছে। চর যেহেতু কৃষিভিত্তিক এলাকা, তাই কীভাবে উন্নয়ন করা যায়, আমরা সে চেষ্টা করছি। আমরা চেষ্টা করছি, চরের মানুষদের সহায়তা করতে। জীবনমান উন্নত করতে আমরা চেষ্টা করব। আমাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
জেলা কৃষি দপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) সৈয়দা সাফাত জাহান বলেন, আমাদের চরাঞ্চলের সব থেকে বেশি উৎপাদন হচ্ছে ভুট্টা। চরের কৃষকের জন্য আলাদা কোনো প্রণোদনা না থাকলেও উপজেলাভিত্তিক যাচ্ছে। সেখান থেকে চরের কৃষকদের প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। সব জায়গায় আমাদের পোস্টেড লোক আছে। উপজেলা যদি দূরে হয়, তাহলে ইউনিয়ন পরিষদে ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার কাছে তাৎক্ষণিকভাবে সব রকম সেবা নিতে পারবে। চরের কৃষির জন্য আমরা নজর দিচ্ছি, বিভিন্ন প্রকল্প দিচ্ছি।