সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: আগামী ১ জানুয়ারি থেকে লাইটার জাহাজে কার্যকর হচ্ছে নতুন ভাড়া। সম্প্রতি এ ঘোষণা দিয়েছে লাইটার জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি)। এতে চট্টগ্রাম থেকে সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় পণ্য পরিবহনে টনপ্রতি ভাড়া বাড়ছে ৫৭ থেকে ১৩৩ টাকা। বর্ধিত ভাড়া কার্যকর হলে দীপথে লাইটার জাহাজে পণ্য পরিবহনের ভাড়া বাড়বে। এতে পণ্য পরিবহনে লোকসানের আশঙ্কা করছেন আমদানিকারকরা।
ডব্লিউটিসির বর্ধিত ভাড়ার তালিকা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মেঘনা, মুক্তারপুর, কাঁচপুর, আলীগঞ্জ ও নিতাইগঞ্জে শিল্পের কাঁচামাল সিমেন্ট ক্লিংকার ও সø্যাগ পরিবহনে টনপ্রতি বতর্মান ভাড়া ৪৮৮ টাকা। এটি ৬০ টাকা বাড়িয়ে ৫৪৮ টাকা করা হয়েছে। এ নৌপথে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ। তবে সর্বোচ্চ ভাড়া বাড়ানো হয়েছে চট্টগ্রাম থেকে খুলনা, নোয়াপাড়া ও শিরমনি এলাকায়। এ নৌপথে টনপ্রতি ১৩৩ টাকা বাড়িয়ে নতুন ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৮০৭ টাকা। এক্ষেত্রে ভাড়া বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। বর্তমানে এ ভাড়া ৬৭৪ টাকা। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর ও জেটি থেকে সারা দেশের ২৯টি গন্তব্যে লাইটার জাহাজে পণ্য পরিবহন ভাড়া বাড়ানো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের নির্বাহী পরিচালক মাহবুবু রশিদ শেয়ার বিজকে বলেন, আমদানিকারকরা যখন পণ্যের দাম বাড়ায়, তখন তারা কারো মতামত নেয় না। তাই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ভাড়া বাড়াতে হবে কেন? এছাড়া সময়ের ব্যবধানে সবকিছুর দামই বাড়ে। কিন্তু লাইটার জাহাজের ভাড়া সমন্বয় করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১২ সালের ৩ জুন ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল। জাহাজ ভাড়া সমন্বয়ের মূল কারণ শ্রমিক মজুরি বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া মজুরি বাড়ানোর সিদ্ধান্তের সময় নৌপরিবহনমন্ত্রী বলেছিলেন ভাড়া সমন্বয় করে নেওয়ার জন্য। তাই বাড়তি ভাড়া ব্যয় হবে শ্রমিক মজুরির পেছনে।
ভাড়ার তালিকা অনুযায়ী, সিমেন্ট ক্লিংকার ও সø্যাগ ছাড়া অন্যান্য আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে বাড়তি ভাড়া দিতে হবে আমদানিকারকদের। যেমন বস্তাভর্তি গম ও ডাল পরিবহনের জন্য যে কোনো গন্তব্যে টনপ্রতি ১১৮ টাকা বাড়তি ভাড়া দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা অঞ্চলে বস্তাবোঝাই গম ও ডাল পরিবহনে নতুন ভাড়া হবে টনপ্রতি ৬৬৬ টাকা।
চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক ও আমদানিকারক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা ছাড়াই এককভাবে লাইটার জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) লাইটার জাহাজ ভাড়া বাড়াচ্ছে। যা কারো জন্য মঙ্গলজনক নয়। এতে অনেক ধরনের সংকট দেখা দিতে পারে। আরেক ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক ও বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, লাইটার জাহাজ সংকটে এখন এমনিতেই পণ্য পরিবহনে খরচ বেড়েছে। নতুন করে ভাড়া বাড়ানো হলে পণ্যের দামে এ খরচ যুক্ত হবে। এতে আমাদের আমদানি খরচ বাড়বে। আর ভোক্তাদের বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে।
উল্লেখ্য, সময়মতো লাইটার জাহাজ বরাদ্দ না পেয়ে একেকটি জাহাজ থেকে পণ্য খালাসে ৪০ থেকে ৭০ দিন পর্যন্ত সময় লাগছে। এর ফলে আমদানিকারক ও শিল্পমালিকরা পণ্য আমদানি করে প্রতি জাহাজে ক্ষতিপূরণ দিচ্ছেন। এর সঙ্গে নতুন করে ভাড়া বাড়ানোর কারণে একেকটি বড় জাহাজে অন্তত ৩০ লাখ টাকা বাড়তি খরচ হবে। ফলে লোকসান, অপ্রত্যাশিত ব্যয় বাড়ানো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার আশঙ্কায় আছেন অধিকাংশ আমদানিকারকরা।
নৌ-মন্ত্রণালয়ের এক হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে সমুদ্রপথে আমদানি পণ্যের ৯৩ শতাংশই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে খালাস হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনারবিহীন আমদানি পণ্যের ৭২ শতাংশ খালাস হয় বহির্নোঙরে। গত অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল তিন কোটি আট লাখ টন। এর মধ্যে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের আওতাধীন লাইটার জাহাজে পরিবহন হয় এক কোটি ৪৯ লাখ ৮১ হাজার টন। এ হিসাবে গড়ে ৭০ টাকা করে ধরা হলেও বছরে বাড়তি ব্যয় দাঁড়াবে ১০৮ কোটি টাকা হবে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
তথ্যমতে, দেশের ইস্পাত খাতের মার্কেট লিডার বিএসআরএম। এ প্রতিষ্ঠান চলতি বছরের লাইটার জাহাজ সংকটের কারণে সময়মতো বার্থি শিডিউল না পাওয়ায় আমদানি করা ইস্পাতের কাঁচামাল খালাস করতে না পারায় ১২টি আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানিগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেবে মোট ১০ কোটি টাকা।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে ৭০ মাদার ভেসেল খালাসের অপেক্ষায় ছিল। এর মধ্যে কোনো কোনো জাহাজ ২০ দিন ধরে বহির্নোঙরে রয়েছে। প্রয়োজনীয় লাইটার জাহাজ না থাকায় কোনো জাহাজ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। ফলে সময়মতো লাইটার জাহাজ বরাদ্দ না পেয়ে একেকটি জাহাজ থেকে পণ্য খালাসে ১২ থেকে ৫০ দিন পর্যন্ত সময় লাগছে। এর ফলে আমদানিকারক ও শিল্পমালিকরা পণ্য আমদানি করে প্রতি জাহাজে ক্ষতিপূরণ দিচ্ছেন। এর সঙ্গে নতুন করে ভাড়া বাড়ানোর কারণে একেকটি বড় জাহাজে অন্তত ৩০ লাখ টাকা বাড়তি খরচ হবে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সহসভাপতি ও চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাড়া বাড়াতে পারে না। ব্যবহারকারীদের সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা না হলে আমদানি খরচ বাড়বে। আর এ বর্ধিত ভাড়া ভোক্তাদের ওপর পড়বে।