নজরুল ইসলাম: ২ ফেব্রুয়ারি ১২ কেজি এলপিজির সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) এক হাজার ৪৯৮ টাকা নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। আর ডিলার ও খুচরা বিক্রেতার কমিশন ৭৫ টাকা বাদ দিলে কোম্পানি পর্যায়ে বিক্রি মূল্য দাঁড়ায় এক হাজার ৪২৩ টাকা। কিন্তু সে দর মানছেন না খোদ এলপিজির উৎপাদকরাই। তারা বিক্রি করছেন এক হাজার ৫২০ টাকায়। অর্থাৎ তারা ৯৭ টাকা বেশি নিচ্ছেন। আর ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা মুনাফা আরও বেশি হারে নিচ্ছে। এতে ভোক্তা পর্যায়ে গিয়ে ১২ কেজি এলপিজিতে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের (ডিএনসিআরপি) এক সেমিনারে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
ডিএনসিআরপি সূত্র জানিয়েছে, ১২ কেজি এলপিজির দর মিলগেটে ওমেরা, লাফস, বসুন্ধরা, ফ্রেশ ও সেনা গ্যাস রাখছে এক হাজার ৫২০ টাকা; আই গ্যাস ও পেট্রোমেক্স এলপিজি রাখছে এক হাজার ৫৩০ টাকা; বেক্সিমকো রাখছে এক হাজার ৫৪০ টাকা এবং টোটাল গ্যাস রাখছে এক হাজার ৪৭১ টাকা, যা পাইকারিতে এক হাজার ৬০০ থেকে এক হাজার ৭০০ টাকা এবং খুচরায় এক হাজার ৭০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ কেউ সরকার-নির্ধারিত দর মানছে না। অথচ ডিলাররাই খুচরা বিক্রেতাদের কাছে এক হাজার ৪৬০ টাকায় বিক্রি করার কথা। এছাড়া তারা কেউই ক্যাশমেমোও দেন না।
এই প্রসঙ্গে বিইআরসি’র সচিব (প্রশাসন ও আইন) ব্যারিস্টার মো. খলিলুর রহমান খান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিইআরসির মূল্য সমন্বয়-সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে এটা স্পষ্ট করা আছে। কোম্পানি, ডিলার, খুচরা বিক্রেতা ও ক্যাবের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তাদের সব ধরনের দাবি (ফ্রেইট, প্রিমিয়াম ও পেট্রোলের দর) মেনেই দর নির্ধারণ করা হয়েছে। ডিলারের ৩৭ ও খুচরা বিক্রেতার ৩৮ টাকা কমিশন নির্ধারণ করা আছে। সেই হিসেবে ৭৫ টাকা বাদ দিলে মিলগেটে কোম্পানির দর দাঁড়ায় এক হাজার ৪২৩ টাকা। এই দামেই ডিলারকে দেয়ার কথা। এটা ফেব্রুয়ারি মাসের দর। গতকাল ভোক্তার সেমিনারে উৎপাদককারীদের দাবি অনুযায়ী নতুন দরের এলসির পণ্য এখনও আসেনি। তার মানে জানুয়ারিতে সমন্বয় করা আগের দরের এলসির পণ্যই তারা এখনও বিক্রি করছেন। সেই হিসেবে ১২ কেজির প্রতিটি এলপিজি মিলগেটে এক হাজার ৫২০ টাকায় বিক্রি করে তারা ৩৬৩ টাকা করে বেশি নিচ্ছেন!’
তার আগে খলিলুর রহমান খান বলেন, ‘৭৯০ ইউএস ডলার সিপি প্রাইস হয়েছে ফেব্রুয়ারিতে। তাদের (উৎপাদনকারীরা) বক্তব্য, এই মাসে এই প্রাইসে কোনো জাহাজ বাংলাদেশে আসেনি। তার মানে এখন বাংলাদেশে ৫৯৯ ইউএস ডলারের এলসির জাহাজ রয়েছে। সেই দর জানুয়ারি মাসের, যেখানে ১২ কেজির এলপিজি এক হাজার ২৩২ টাকা ছিল। তাহলে বেশি দামে তারা পণ্য বিক্রি করবেন কেন? আমাদের গণশুনানিতে তারা ডকুমেন্টারি স্টেটমেন্ট দেননি। বারবার চিঠি দেয়ার পরও তারা দেননি। তারা মুখে বলেন। মুখের কথায় তো আমরা দাম বাড়াতে পারি না। তারা বারবার সময় চান, কিন্তু ডকুমেন্ট দেন না। তারা যদি সরকারের নির্ধারিত দাম না মানেন, সেটা তাদের ব্যাপার। প্রতি মাসে তাদের সঙ্গে কথা হয়। তাদের সম্মতি নিয়ে দাম সমন্বয় করা হয়।’
গত ২ ফেব্রুয়ারি খুচরা বিক্রেতা পর্যায়ে ১২ কেজি এলপিজির দর সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য এক হাজার ৪৯৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়, যা গত ২ জানুয়ারি এক হাজার ২৩২ টাকা ও গত ৪ ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয় এক হাজার ২৯৭ টাকা।
দরের বিষয়ে জানতে চাইলে মেঘনা গ্রুপের চিফ অপারেটিং অফিসার নুরুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা মিলগেটে ফ্রেশের ১২ কেজি এলপিজির দর এক হাজার ৫১০ টাকা ধরি। পরে মাস শেষে ইনসেনটিভ ও ক্যারিং খরচ ফেরত দিই।’
সেমিনারে ডিএনসিআরপির পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, ‘উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা শুনলাম, মনে হলো তাদের দুঃখ। যখন ডিলারদের কথা শুনলাম তখন মনে হলো তাদের। আবার যখন খুচরা বিক্রেতাদের কথা শুনলাম, মনে হলো তাদের দুঃখ। আবার যখন বিইআরসির ব্যাখ্যা শুনলাম, তখন দেখলাম শুভংকরের ফাঁকি। ভোক্তা আইনে অনেক ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে। শুনানি নিয়ে প্রয়োজনে আমরা সিআর মামলার দিকে যাব। এভাবে চলতে পারে না। আমরা যখন খুচরা দোকানে অভিযানে চালাই, তারা আঙুল তোলে ডিলারদের বিরুদ্ধে।’
সেমিনারে ডিএনসিআরপির মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘প্রতিটা জায়গায় বিশৃঙ্খলা রয়েছে। ২৬৬ টাকা বাড়ানোর পরও তার কোনো প্রতিফলন বাজারে নেই। আপনারা বারবার বাড়ানোর কথাই বলছেন। বাড়ানোর পর আবারও একই দাবি করছেন। আমরা যদি শিথিলতা দেখাই, তখন আরও বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। আমি ভোক্তার ডিজি হিসেবে ভোক্তার স্বার্থ দেখছি। ১২ কেজি এক হাজার ৪৯৮ টাকাতেই বিক্রি করতে হবে।’
ডিলার আবু তাহের কোরেশি বলেন, ‘২০১৬-১৭ সালে সময়ে অনেক গ্যাস ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে গেছে। উৎপাদনকারীরা অসম প্রতিযোগিতায় আমাদের নামিয়ে দিয়েছিল। গ্যাসের দাম কমে গিয়েছিল। আমরা পুঁজি হারিয়েছিলাম।
ক্যাব প্রতিনিধি কাজী আবদুল হান্নান বলেন, ‘বাজারে তো প্রতিযোগিতা হওয়ার কথা, ভোক্তার লাভ হওয়ার কথা। কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না। বিপণন ব্যবস্থায় যে সংকট, সেটা কেন বিইআরসি দেখছে না? মূল্য নির্ধারণের পরও কেন ভোক্তা নির্ধারিত মূল্যে পাচ্ছে না? মফস্বলে ১২ কেজির এলপিজি এক হাজার ৯০০ টাকাও নিচ্ছে। বিইআরসি বারবার ভোক্তার জন্য খরচ বাড়াবে, উৎপাদনকারীর মুনাফা বাড়াবেÑএটা কি বিইআরসির কাজ? ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর খুচরা বিক্রেতাকে জরিমানা করছে, ভালো কথা; কিন্তু যে কোম্পানি বারবার দাম বেশি নিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’
এলপি গ্যাস ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির প্রেসিডেন্ট সেলিম খান বলেন, ‘আমরা অসহায়। পাঁচ-ছয় দিন ধরে পণ্য পাচ্ছি না। মিলের সামনে ট্রাক দাঁড় করানো।’