নিয়াজ মাহমুদ: পুঁজিবাজারের জন্য আরেকটি সুখবর দিয়েছে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের লেনদেন। বিদায়ী বছরে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বৈদেশিক লেনদেন নতুন রেকর্ড করেছে। আলোচ্য বছরে বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চেয়ে কেনার পরিমাণ ছিল বেশি। এ বছর বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীরা লেনদেন করেছেন আট হাজার ৭৭৩ কোটি ২৯ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট; যা দেশের পুঁজিবাজারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বার্ষিক লেনদেন।
ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, বিদায়ী বছরে বিদেশিদের শেয়ার কেনাবেচার পার্থক্যও ছিল বেশ ইতিবাচক। বছরটিতে বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চেয়ে কেনা বেশি হয়েছে এক হাজার ৩৪০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা, যা ২০১৫ সালে ছিল ১৮৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় বিদেশিদের শেয়ার কেনাবেচার (বিক্রি থেকে কেনা বেশি) পার্থক্য বেড়েছে এক হাজার ১৫৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা বা ৭২২ শতাংশ।
বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিদেশিদের আগ্রহ বাড়ার যে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তা পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক। বিদেশিরা সাধারণত ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করে থাকেন; কিন্তু গত কয়েক বছরে বাজারে মাল্টিন্যাশনাল কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়নি। এসব কোম্পানি পুঁজিবাজারে এলে বাজারে ভালো শেয়ারের সংকট কেটে যাবে। তখন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ আরও বৃদ্ধি পাবে। বিদেশিরা বিনিয়োগ করলে অনেক সময় বাজারে গতি ফেরে। তাদের দেখাদেখি দেশি বিনিয়োগকারীরা আশান্বিত হয়ে বাজারে আসবেন বলে মনে করছেন তারা।
ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে ডিএসইতে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীরা লেনদেন করে সাত হাজার ৪৬৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকার শেয়ার। আর ২০১৬ সালে লেনদেন করেছে আট হাজার ৭৭৩ কোটি ২৯ লাখ টাকার শেয়ার। বছরের ব্যবধানে লেনদেন বেড়েছে এক হাজার ৩০৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। ২০১৪ সালে ডিএসইতে বিদেশিদের মোট লেনদেন ছিল ছয় হাজার ৬০০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।
ডিসেম্বরে বিদেশিদের শেয়ার লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৭৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা; যা মাসভিত্তিক হিসাবে পুঁজিবাজারে নতুন রেকর্ড। এর আগের ১১ মাসে (জানুয়ারি-নভেম্বর ’১৬) ডিএসইতে বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীরা সাত হাজার ৭৯৭ কোটি ৩০ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন করেছেন।
সংশ্লিষ্টদের মতে, সম্প্রতি সূচক ও লেনদেনের উন্নতি হওয়ায় বাজার চাঙ্গা হচ্ছে। এর ফলে বাড়ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীর পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারীর আগ্রহ।
সামষ্টিক অর্থনৈতিক ইতিবাচক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করায় পুঁজিবাজারে বিদেশিদের লেনদেন বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বর্তমানে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদর যে পর্যায়ে রয়েছে, এ পরিস্থিতিতে ভালো করে তথ্য যাচাই-বাছাই করে বিনিয়োগ করলে লোকসানের খুব একটা সম্ভাবনা নেই। বরং ভালো শেয়ার কিনে কিছুদিন ধরে রাখলে ভালো মুনাফা পাওয়া যাবে। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে বাজারের ওপর বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেড়েছে।
লেনদেনের পাশাপাশি যেহেতু বিদেশিরা শেয়ার বিক্রির চেয়ে কিনছে বেশি, সেহেতু এটি সার্বিক বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা।
বিদেশিরা অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশকে এখন বেশি লাভজনক মনে করছেন, তাই তাদের বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন বলেও মনে করছেন ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিদেশিরা সব সময় কোম্পানির সার্বিক অবস্থা ও বর্তমান শেয়ারের দাম দেখে গবেষণার পর শেয়ার কেনেন। এটা পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক। মন্দার বাজারে বিদেশিদের বিনিয়োগ দেশি বিনিয়োগকারীর জন্য অনুপ্রেরণা।’
ডিএসই ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কেএএম মাজেদুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমাদের শেয়ারবাজারের প্রতি বিদেশিদের আগ্রহ আছে। গত কয়েক মাসে দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশিদের বিনিয়োগ বেড়েছে। বিদেশি যেসব প্রতিষ্ঠান দেশের ডিএসইর স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে, তারা বাজারে এলে বাজারের অবস্থা উন্নত হবে। কারণ ওইসব কোম্পানির বিশ্বের বিভিন্ন শেয়ারবাজারে অংশগ্রহণ রয়েছে।’
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের লেনদেন বাড়া ভালো লক্ষণ উল্লেখ করে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘বিদেশিরা সাধারণত ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করে থাকেন; কিন্তু গত কয়েক বছরে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি বাজারে আসেনি। অথচ অনেক বিদেশি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা করছে। ভারতে বিদেশি কোম্পানি ব্যবসা করতে চাইলে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তিতে বাধ্যবাধকতা রয়েছে; কিন্তু আমাদের দেশে নেই। বাজারে ভালো শেয়ারের সংকট রয়েছে। এ সংকট দূর করতে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। বিদেশিরা বিনিয়োগ করলে অনেক সময় বাজারে গতি ফেরে। তাদের দেখাদেখি দেশি বিনিয়োগকারীরা আশান্বিত হয়ে বাজারে আসেন।’