ইসমাইল আলী: উত্তরা থেকে মতিঝিল সড়কপথে দূরত্ব প্রায় ২২ কিলোমিটার। যানজট না থাকলে এ পথ পাড়ি দিতে সময় লাগে ৫৮ মিনিট। তবে নিত্য যানজটের সঙ্গী এ শহরে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত পৌঁছাতে তিন থেকে চার ঘণ্টা লেগে যায়। এ পথে পাড়ি দেওয়া যাবে মাত্র ৩৭ মিনিটে। এজন্য নির্মাণ শুরু করা হচ্ছে ম্যাস র্যা পিড ট্রানজিট (এমআরটি) বা মেট্রোরেল-৬। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৯ সালেই নগরবাসী এটি ব্যবহার করতে পারবেন।
গত জুনে মেট্রোরেল-৬-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে এ প্রকল্পের একটি প্যাকেজের কাজ শুরু হয়েছে। আর মূল মেট্রোরেলের কাজ শুরু হবে আগামী বছর।
২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) সভায় প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের প্রাক্কলিত সময় ধরা হয় ১২ বছর। সে সময়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী, মেট্রোরেলের নকশা প্রণয়ন ও জমি অধিগ্রহণে সময় লাগবে তিন বছর। পাশাপাশি চলবে ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া। ২০১৭ সালে শুরু করা হবে নির্মাণকাজ, যা শেষ হবে ২০২১ সালে। তবে ২০১৯ সালেই নগরবাসী মেট্রোরেলে চড়তে পারবে বলে ধারণা। কারণ প্রথম ধাপে ২০১৯ সালের মধ্যে পল্লবী থেকে হোটেল সোনারগাও পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার নির্মাণকাজ শেষ করা হবে। এর পরের বছর চালু হবে সোনারগাও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত। আর ২০২১ সাল নাগাদ চালু হবে উত্তরা থেকে পল্লবীর অংশ। তবে নির্মাণ-পরবর্তী অন্যান্য কাজ শেষ হতে সময় লাগবে ২০২৪ সাল।
মেট্রোরেল উত্তরার তৃতীয় পর্ব থেকে উত্তরা সেন্টার, পল্লবী, মিরপুর-১০ সেকশন দিয়ে কাজীপাড়া, রোকেয়া সরণির পশ্চিম পাশ দিয়ে খামারবাড়ী হয়ে ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, টিএসসি, দোয়েল চত্বর হয়ে তোপখানা রোড দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত যাবে। এ পথে স্টেশন থাকবে ১৬টি। এসব স্টেশন থেকে যাত্রীরা ওঠানামা করতে পারবেন। প্রতিটি স্টেশনে ট্রেন থামবে সাড়ে তিন মিনিট। স্টেশনগুলো হচ্ছেÑউত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, আইএলটি, মিরপুর সেকশন-১০, কাজীপাড়া, তালতলা, আগারগঁাঁও, খামারবাড়ী, ফার্মগেট, সোনারগাঁও, জাতীয় জাদুঘর, দোয়েল চত্বর, প্রেস ক্লাব, জাতীয় স্টেডিয়াম ও বাংলাদেশ ব্যাংক। উত্তরা মডেল টাউনের তৃতীয় পর্যায়ের এলাকায় মেট্রোরেলের প্রধান ডিপো স্থাপন করা হবে।
মেট্রোরেল কি মাটি দিয়ে না মাটির নিচ দিয়ে চলবে এ প্রশ্নটা অনেকের মনেই জাগে। তবে মাটি বা মাটির নিচ দিয়ে এ রেল চলবে না। এটি চলবে ফ্লাইওভারের মতো উড়ালপথে। আর এর স্টপেজেও হবে মাটির ওপরে। সিঁড়ি বেয়ে স্টপেজে উঠে ট্রেনে চড়তে হবে।
মেট্রোরেল চালুর ফলে ঢাকায় মতিঝিল থেকে মিরপুর ও উত্তরা রুটে রাজধানীবাসীর যাতায়াত অনেক সহজ হয়ে যাবে। এ দুই রুটে যানবাহন চলাচলও অনেক কমে যাবে। মেট্রোরেল ঘণ্টায় প্রায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করবে। প্রতি চার মিনিট অন্তর অন্তর উভয় দিক থেকে ট্রেন ছাড়বে। ঢাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে সংযোগ সৃষ্টিকারী মেট্রো শহরের যানজট হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। যানজটের কারণে উত্তরা থেকে মতিঝিলে আসতে সময় লাগে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা। কিন্তু মেট্রোরেল চালু হলে এই পথ পাড়ি দেওয়া যাবে মাত্র ৩৭ মিনিটে, যা মানুষের ভোগান্তি বহুলাংশে কমিয়ে দেবে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উত্তরায় রাজউকের প্রায় ৫৯ একর জমিতে মেট্রোরেল ডিপোর ভূমি উন্নয়নের কাজ চলছে। দিয়াবাড়ি খালের দুই পাশে বিরান ভূমি। খালের ওপর একটি সেতু। এর উত্তর পাশে ধরেই চলছে নির্মাণকাজ। ৫৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে এ কাজ পেয়েছে টোকিং কনস্ট্রাকশন। তাদেরই এ দেশীয় সহযোগী সিনাম ইঞ্জিনিয়ারিং। চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৭ সালে শেষ হবে ডিপোর ভূমি উন্নয়নের কাজ। এরপর শুরু করা হবে মূল ডিপো নির্মাণের কাজ, যেখানে রাখা হবে মেট্রোরেলের কোচ-ইঞ্জিন।
আটটি প্যাকেজে ভাগ করা হয়েছে দেশের প্রথম মেট্রোরেলের (এমআরটি-৬) কাজ। এরই মধ্যে কোচ-ইঞ্জিন কেনায় দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা উন্নয়নের কাজেরও দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এছাড়া মূল রুটের উত্তরা থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত নির্মাণকাজের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। আর কারওয়ান বাজার থেকে মতিঝিল পর্যন্ত দরপত্র আহ্বানের কাজ চলছে।
প্রথম পর্যায়ে ২০১৯ সালের মধ্যে আগারগাঁও পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার বাণিজ্যিকভাবে চলাচল শুরু হবে। আর ২০২০ সালের মধ্যে মতিঝিল পর্যন্ত বাকি অংশ মেট্রোরেল নির্মাণকাজ শেষ হবে সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী। প্রথম পর্যায়ে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলের ৯টি স্টেশন থাকবে। ডিপো থেকে যাত্রা শুরু করে মেট্রো প্রথমে উত্তরা নর্থ, এরপর পর্যায়ক্রমে উত্তরা সেন্টার, উত্তরা সাউথ, পল্লবী, আইএমটি, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, তালতলা হয়ে আগারগাঁও। পরিকল্পনা অনুযায়ী মোট ১৬টি স্টেশন হবে। পরবর্তী পর্যায়ে আগারগাঁও থেকে বিজয় সরণি, ফার্মগেট, সোনারগাঁও মোড়, জাতীয় জাদুঘর, দোয়েল চত্বর, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম, শাপলা চত্বরে। প্রতি সাড়ে তিন মিনিট পর স্টেশনে থামবে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা ম্যাস র্যা পিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের পরিচালক মো. মোফাজ্জল হোসেন শেয়ার বিজকে জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ও জাপান সরকারের অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ এগিয়ে আনা হয়েছে। প্রাথমিক কাজ অনেক আগেই শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে কাজের ক্ষেত্রে নতুন গতি আসবে। ২০১৯ সালের মধ্যে প্রথম অংশ এবং ২০২০ সালের মধ্যে বাকি অংশসহ পুরো কাজ শিডিউল অনুযায়ী সমাপ্ত হবে।
মেট্রোরেলের ঘণ্টায় গতি হবে গড়ে ৩২ কিলোমিটার। তবে সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার গতিতে চলবে এ ট্রেন। এই রুটে চলাচল করবে মোট ১৪টি ট্রেন। প্রতিটিতে ছয়টি করে বগি থাকবে। প্রতিটি ট্রেনে ৯৪২ জন যাত্রী বসে এবং ৭৫৪ জন দাঁড়িয়ে যাতায়াত করবে। প্রতি চার মিনিট পর পর ট্রেন ছেড়ে যাবে।
২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে মেট্রোরেল বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ১৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। বাকি পাঁচ হাজার ৪০০ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে।