ইসমাইল আলী: কয়েক বছর ধরে দ্রুত বাড়ছে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ। এর মধ্যে ২০২১ সালে বৈদেশিক ঋণ সবচেয়ে বেশি হারে বাড়ে। এ সময় সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই বৈদেশিক ঋণ রেকর্ড বৃদ্ধি পায়। এর প্রভাবে বিদেশিক ঋণ পরিশোধও বাড়ছে দ্রুত। ২০২১ সালে এ বৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ৪২ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
‘ইন্টারন্যাশনাল ডেট রিপোর্ট ২০২২’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনে ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতি ও পরিশোধের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশ বিদেশি ঋণ পরিশোধ করেছে প্রায় পাঁচ দশমিক ২৯৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে আসল পরিশোধ করা হয় চার দশমিক ২০৭ বিলিয়ন ডলার ও সুদ পরিশোধ করেছে এক দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার।
এর আগের বছর (২০২০ সালে) বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল তিন দশমিক ৭৩৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে আসল পরিশোধ করা হয় দুই দশমিক ৮৭১ বিলিয়ন ডলার ও সুদ পরিশোধ করে শূন্য দশমিক ৮৬৩ বিলিয়ন ডলার। এর এক দশক আগে অর্থাৎ ২০১০ সালে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল এক দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে আসল পরিশোধ করা হয় শূন্য দশমিক ৮২১ বিলিয়ন ডলার ও সুদ শূন্য দশমিক ২০৩ বিলিয়ন ডলার।
যদিও ২০১৯ সালে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করে। ওই বছর বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল পাঁচ দশমিক ৪৮৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে আসল ছিল চার দশমিক ৬৮১ বিলিয়ন ডলার ও সুদ শূন্য দশমিক ৮০৮ বিলিয়ন ডলার।
গত বছর বিদেশি ঋণ (আসল) পরিশোধের মধ্যে সরকারের ছিল এক দশমিক ৭৮৭ বিলিয়ন ডলার ও বেসরকারি দুই দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। আর ২০২০ সালে সরকারের বিদেশি ঋণ (আসল) পরিশোধ করা হয় এক দশমিক ৩০৭ বিলিয়ন ডলার ও বেসরকারি এক দশমিক ৫৬৫ বিলিয়ন ডলার।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘২০২৬ সালের পর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পসহ বেশকিছু বড় ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে। ইআরডির হিসাব অনুযায়ী, ওই সময় থেকে মোট বিদেশি ঋণের বিপরীতে যে কিস্তি পরিশোধ করতে হবে, তাতে আসল বাবদই প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। এর বাইরে বিভিন্ন ধরনের বায়ার্স ক্রেডিট, ডেফার্ড এলসি ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ মিলে আরও কয়েক বিলিয়ন ডলার যুক্ত হবে। কাজেই এক ধরনের চাপ তো বাড়বেই। সেজন্য সরকারকে এখন থেকে কৌশল গ্রহণ করা উচিত।’
তথ্যমতে, গত বছর শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৯১ দশমিক ২৪৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে এর পরিমাণ ছিল ৭৩ দশমিক ৫০৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বেড়েছে ১৭ দশমিক ৭৪২ বিলিয়ন ডলার বা ২৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। আর ২০১৯ সালে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ৬২ দশমিক ৪২৭ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ৫৭ দশমিক ০৮৯ বিলিয়ন ডলার ও ২০১৭ সালে ৫১ দশমিক ০৪১ বিলিয়ন ডলার। আর ২০১০ সালে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ২৬ দশমিক ৫৭২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ১১ বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে আড়াইগুণ।
এদিকে গত বছর বিদেশি ঋণ ছাড়ের পরিমাণ ছিল ১৩ দশমিক ৭৭৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরকারের ৯ দশমিক ৩৬৫ বিলিয়ন ডলার ও বেসরকারি চার দশমিক ৪১০ বিলিয়ন ডলার। আর ২০২০ সালে বিদেশি ঋণ ছাড়ের পরিমাণ ছিল ১০ দশমিক ২১৭ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরকারের সাত দশমিক ৬৯৫ বিলিয়ন ডলার ও বেসরকারি দুই দশমিক ২৭০ বিলিয়ন ডলার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে স্বল্পমেয়াদি ঋণের চাপই বেশি। কেননা এসব ঋণ কম সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে হয়। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ বাড়ে। আমদানির তুলনায় রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ শক্তিশালী না হলেই ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে এসব দেশকে চাপে পড়তে হয়। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানিনির্ভর দেশগুলো বৈদেশিক বাণিজ্যে বড় চাপে পড়ে। এ চাপ সামাল দিতে এখন কম সুদের শর্তযুক্ত এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিচ্ছে এসব দেশ।
শর্ত এড়াতে এসব দেশ চড়া সুদের বাণিজ্যিক ঋণই বেশি নিয়ে থাকে। কিন্তু বহুমুখী উৎস থেকে স্বল্প সুদের ঋণ নেয় কম। এসব ঋণ দিয়ে থাকে বহুমুখী উন্নয়ন সংস্থাগুলো। যে কারণে স্বল্পোন্নত দেশের ওপর বৈদেশিক ঋণের চাপ বেশি।
উল্লেখ্য, ২০২১ সাল শেষে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭০ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ ১৮ দশমিক ০৮৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬০ দশমিক ৪১২ বিলিয়ন ডলার ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ ১০ দশমিক ৯৮৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেড়েছে ৯ দশমিক ৬২৮ বিলিয়ন ডলার ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেড়েছে সাত দশমিক ১০২ বিলিয়ন ডলার।
গত বছর শেষে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের মধ্যে সরকারের ঋণ ছিল ৫৩ দশমিক ৭৪২ বিলিয়ন ডলার এবং সরকারের গ্যারান্টিকৃত ঋণ ছিল আট দশমিক ৬৮৩ বিলিয়ন ডলার।