প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

২৫ বছরে আদানি নিয়ে যাবে ৬৩.২৫ বিলিয়ন ডলার!

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি

ইসমাইল আলী: ভারতের ঝাড়খণ্ডে নির্মিত আদানির গড্ডা কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে ২৫ বছর বিদ্যুৎ কিনবে বাংলাদেশ। আগামী মার্চে এ বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরুর কথা রয়েছে। এ বিদ্যুতের জন্য মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ৩৯ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলার। বিদ্যুৎ না কিনলেও এ চার্জ দিতে হবে। আর আদানির কেন্দ্র থেকে পূর্ণ সক্ষমতায় (৮৫ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টর) বিদ্যুৎ কিনলে মাসে বাংলাদেশকে গুনতে হবে ২১০ দশমিক ৮৫ মিলিয়ন ডলার।

এ হিসাবে ২৫ বছরে (পূর্ণ সক্ষমতায়) বিদ্যুৎ বিক্রি করে বাংলাদেশ থেকে আদানি নিয়ে যাবে প্রায় ৬৩ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। এর বিনিময় হার ১০৬.৯৫ টাকা ধরে এ ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ছয় লাখ ৭৬ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের চলতি অর্থবছরের বাজেটের সমান। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

যদিও সাম্প্রতিক ধাক্কায় গত সপ্তাহে দু’দিন প্রায় ৫২ বিলিয়ন (পাঁচ হাজার ২০০ কোটি) ডলার বাজারদর হারিয়েছে আদানি গ্রুপের ৯ কোম্পানি শেয়ার। দেশীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকার বেশি। সম্প্রতি এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে গৌতম আদানি ও তার সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি এবং প্রতারণার অভিযোগ তোলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগ গবেষণা সংস্থা হিনডেনবার্গ রিসার্চ। তাদের ওই প্রতিবেদনের জেরে এশিয়ার শীর্ষ ধনীর ওপর ব্যাপক চাপ তৈরি হয়েছে। যদিও আদানির পক্ষ থেকে দুর্নীতির তথ্য মিথ্যা দাবি করা হয়েছে।

পিডিবির তথ্যমতে, আদানির কেন্দ্রটিতে পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন করা হলে মাসে প্রায় ৯২ কোটি ৮২ লাখ ৬৮ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এজন্য কয়লার দাম বাবদ গুনতে হবে ১৭০ দশমিক ২৯ মিলিয়ন ডলার। আর ভিওএমপি (পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়) বাবদ ব্যয় হবে এক দশমিক ১৩ মিলিয়ন ডলার। এছাড়া মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে ৩৯ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ মোট ব্যয় হবে ২১০ দশমিক ৮৫ মিলিয়ন ডলার বা দুই হাজার ২৫৫ কোটি চার লাখ টাকা।

এ হিসাবে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে ৪৭৩ দশমিক ১৬ মিলিয়ন ডলার। আর ২৫ বছরে এ চার্জ বাবদ ব্যয় হবে প্রায় ১১ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার বা এক লাখ ২৬ হাজার ৫৮১ কোটি টাকা। আর পূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ কিনলে বছরে আদানিকে পরিশোধ করতে হবে ২ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার। এতে ২৫ বছরে গুনতে হবে ৬৩ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার।

এদিকে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে আদানির গড্ডা কেন্দ্রে কয়লার দাম ধরা হয়েছে প্রায় ৪২ শতাংশ বেশি। এতে আদানির বিদ্যুৎ কিনলে মাসে বাংলাদেশের গচ্চা যাবে প্রায় ছয় কোটি ৪০ লাখ ডলার বা ৭০০ কোটি টাকা। উভয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য একই ক্ষমতার কয়লা ও তার মূল্য বিবেচনা করে পিডিবি এ হিসাব দেখিয়েছে।

ঝাড়খণ্ডে নির্মিত আদানির কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন করা হলে জ্বালানি ব্যয় পড়বে ইউনিটপ্রতি ১৮ দশমিক ৩৪ সেন্ট। আর জ্বালানি-বহির্ভূত ব্যয় (ক্যাপাসিটি চার্জ এবং ভিওএমপি) পড়বে চার দশমিক ৩৭ সেন্ট। অর্থাৎ গড় উৎপাদন ব্যয় পড়বে ২২ দশমিক ৭১ সেন্ট বা ২৪ টাকা ২৯ পয়সা।

অন্যদিকে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন করা হলে মাসে জ্বালানি ব্যয় পড়বে ইউনিটপ্রতি ১২ দশমিক ৯৯ সেন্ট। আর জ্বালানি-বহির্ভূত ব্যয় (ক্যাপাসিটি চার্জ) পড়বে চার দশমিক ২১ সেন্ট। এতে গড় উৎপাদন ব্যয় পড়বে ১৭ দশমিক ২০ সেন্ট বা ১৮ টাকা ৪০ পয়সা। অর্থাৎ পায়রার তুলনায় আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন ব্যয় বেশি পড়ে প্রতি ইউনিটে পাঁচ টাকা ৮৯ পয়সা বা ৩২ শতাংশ।

পিডিবির তথ্যমতে, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমদানিকৃত কয়লার দাম ধরা হয়েছে প্রতি মেট্রিক টন ২৪৫ ডলার। প্রতি কেজি এ কয়লার ক্যালোরিফিক ভ্যালু (তাপন ক্ষমতা) ধরা হয়েছে চার হাজার ৬০০ কিলোক্যালরি। একই মানের কয়লা আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কেনা হচ্ছে ৩৪৭ ডলারে। এ হিসাবে পায়রার বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে আদানির কেন্দ্রে কয়লার দাম বেশি ধরা হয়েছে প্রতি মেট্রিক টনে ১০২ ডলার বা ৪১ দশমিক ৬৩ শতাংশ।

পায়রার সঙ্গে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লার দামের তুলনামূলক বিশ্লেষণ নিয়ে পিডিবি দেখায়, নিউক্যাসল কোল ইনডেক্স অনুযায়ী গত ডিসেম্বরে কয়লার দাম ছিল প্রতি মেট্রিক টন ৪০৪ ডলার। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যে মানের কয়লা কেনা হচ্ছে, তাতে প্রতি মেট্রিক টনে ৪৫ শতাংশ ডিসকাউন্ট দেয়া হয়। চুক্তিমতে, প্রতি টন কয়লার দাম ১১০ ডলারের বেশি হলে বাড়তি দামের ৫৫ শতাংশ পরিশোধ করতে হয় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে।

তবে আদানির সঙ্গে ২০১৭ সালে সম্পাদিত চুক্তিতে ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টর বিবেচনা করা হয়নি। এতে চুক্তির ভুলে আদানির কয়লার জন্য পুরো দামই পরিশোধ করতে হবে। এতে চার হাজার ৬০০ কিলোক্যালরি তাপন ক্ষমতার কয়লায় মাসে গচ্চা যাবে প্রায় ৬৪ মিলিয়ন ডলার বা ৬৮৪ কোটি টাকা।

আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সরকারের দেয়া বাড়তি সুবিধা এখানেই শেষ নয়। চুক্তির ভুলে আরও সুবিধা পাবে আদানি। এক্ষেত্রে যদি আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র পূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ দিতে প্রস্তুত থাকে, তবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) কোনো কারণে চাহিদা দিয়েও সে অনুযায়ী বিদ্যুৎ না কেনে, তবুও আদানি কয়লার পুরো মূল্যই পাবে। তবে দেশীয় অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো শর্ত রাখা হয়নি।

সূত্র জানায়, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যয়ের মধ্যে কয়লার দাম ও ভিওএমপি ডলারে পরিশোধ করতে হয়। আর ক্যাপাসিটি চার্জ ডলারের বিনিময় হার ধরে টাকায় পরিশোধ করা হয়। তবে কোম্পানিগুলো এ অর্থ আবার ডলারে রূপান্তর করে দেশের বাইরে নিয়ে যায়। তাই প্রত্যক্ষভাবে ডলারে বিল না দিলেও দেশের বাইরে ডলার চলে যাবে। এছাড়া ক্যাপাসিটি চার্জ যেদিন দাবি করা হয়, সেদিন ডলারের রেট কম হলেও পরবর্তী সময়ে তা বেড়ে গেলে বর্ধিত হারেই এ চার্জ পরিশোধ করতে হয়।

যদিও বাস্তবে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সক্ষমতার পুরো বিদ্যুৎ কেনা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন পিডিবির কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, আদানির সঙ্গে বৈঠকে তাদের কয়লার উচ্চ দাম নিয়ে আপত্তি তোলা হয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের তুলনামূলক হিসাবের বিবরণী দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি কয়লার দাম আগে ঘোষণা করার কথা বলা হয়েছে। তাদের ঘোষণার ওপর নির্ভর করবে আদানির বিদ্যুৎ কেনা হবে কিনা বা কতটা কেনা হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মাহবুুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, আদানির বিদ্যুৎ মার্চে সরবরাহ শুরুর কথা রয়েছে। এর প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই বৈঠক হয়েছে। এর চেয়ে বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।

আরো পড়ুন :