প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

৬৫ শতাংশ খেলাপি ঋণ শীর্ষ ১০ ব্যাংকে

রোহান রাজিব: ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের ৬৫ শতাংশ রয়েছে শীর্ষ ১০ ব্যাংকে। বাকি ৫১টি ব্যাংকে ৩৫ শতাংশ। দেশের ৬১টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে শীর্ষ ১০টি ব্যাংকে রয়েছে ৮৭ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৫১টি ব্যাংকে রয়েছে ৪৭ হাজার কোটি টাকা।

গতকাল রোববার প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রৈমাসিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গিয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক ঝুঁকির মাত্রা তুলে ধরে। তবে এতে কোনো ব্যাংকের নাম প্রকাশ করা হয় না।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ থাকায় শীর্ষ পাঁচটি ব্যাংকের বেশি ঝুঁকি রয়েছে। একই সঙ্গে শীর্ষ ১০টি ব্যাংকের ঝুঁকিও কম নয়। তবে শীর্ষ পাঁচ ব্যাংকের চেয়ে কম। খেলাপি ঋণের কারণে এসব ব্যাংকের মোটা অঙ্কের অর্থ প্রভিশন খাতে আটকে রয়েছে। এর বিপরীতে মূলধন ঘাটতিও রয়েছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকির মাত্রা বেড়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, খেলাপি ঋণ যেমন শীর্ষ ১০ ব্যাংকের সবচেয়ে বেশি, তেমনই সম্পদের দিক থেকেও অন্য ১০টি ব্যাংক এগিয়ে রয়েছে। ব্যাংক খাতে মোট সম্পদের ৪৫ শতাংশ রয়েছে ১০ ব্যাংকের হাতে। বাকি ৫১ ব্যাংকের হাতে রয়েছে ৫৫ শতাংশ সম্পদ। শীর্ষ পাঁচ ব্যাংকের হাতে রয়েছে ৩১ শতাংশ সম্পদ। বাকি ৫৬ ব্যাংকের হাতে রয়েছে ৬৮ শতাংশ সম্পদ। ব্যাংকগুলোর মধ্যে সুষম প্রতিযোগিতা না থাকার কারণে সম্পদ আহরণেও বৈষম্য রয়েছে। ব্যাংকগুলোর সম্পদ বলতে ঋণকে বোঝায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, তুলনামূলকভাবে কম খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা শক্তিশালী করতে পারে। কিন্তু ব্যাংক খাতে ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। এতে আর্থিক খাতের সম্পদের মান খারাপ হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে ঋণ নবায়নের মাত্রা কমে যাওয়ার কারণে সার্বিকভাবে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ব্যাংক খাতে সম্পদ ও খেলাপি ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে। এতে ঝুঁকির মাত্রা আরও বেড়েছে। ঋণের প্রবাহ কয়েকটি ব্যাংকে বেশি, যে কারণে এসব ব্যাংকের কারণে ঝুঁকির মাত্রাও বেশি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে ২০ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে ৯টি ব্যাংকের। ১৫ শতাংশের বেশি থেকে ২০ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ রয়েছে তিনটি ব্যাংকের। ১০ শতাংশের বেশি থেকে ১৫ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ রয়েছে চারটি ব্যাংকের। পাঁচ শতাংশের বেশি থেকে ১০ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ রয়েছে ১১টি ব্যাংকের। তিন শতাংশের বেশি থেকে পাঁচ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ আছে ২২টি ব্যাংকের। দুই শতাংশের বেশি থেকে তিন শতাংশের কম খেলাপি রয়েছে পাঁচটি ব্যাংকের। দুই শতাংশের কম খেলাপি ঋণ আছে ছয়টি ব্যাংকের।

উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিকভাবে মোট ঋণের তিন শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ হলে ওই ব্যাংককে ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে ধরা হয়।

দুই শতাংশের কম খেলাপি ঋণ থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংক। মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে ৮৮ দশমিক ২১ শতাংশ দুই বছরের বেশি সময় ধরে খেলাপি হয়ে রয়েছে। অর্থাৎ মোট খেলাপি ঋণের এক লাখ ১৮ হাজার ৫৫০ কোটি টাকাই আদায়-অযোগ্য ঋণে পরিণত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মে কোনো খেলাপি ঋণ দুই বছরের বেশি সময় আদায় না হলে তাকে আদায়-অযোগ্য ঋণ হিসাবে ধরা হয়।

মোট খেলাপির মধ্যে নতুন খেলাপি হয়েছে মাত্র ৭ দশমিক ৮১ শতাংশ ঋণ, অর্থাৎ ১০ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। খেলাপি হওয়ার পর ছয় মাস অতিক্রম হলে তাকে সন্দেহজনক ঋণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। খেলাপি হওয়ার পর সন্দেহজনক পর্যায়ে গিয়েছে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ ঋণ, অর্থাৎ পাঁচ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে ঋণ, আমানত ও মূলধন কমেছে। ২০২২ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতে মূলধন ছিল ছয় হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তা কম হয়েছে ছয় হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে ৬৪৪ কোটি টাকার মূলধন কমেছে। খেলাপি ঋণ বাড়ার ও ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বাড়ার কারণে ব্যাংক খাতে মূলধন কমেছে। এছাড়া তিন মাসের ব্যবধানে আমানত কমেছে ৭২৬ কোটি টাকা। গত বছরের জুনে ব্যাংক খাতে আমানত ছিল ৪৫ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে তা কমে ৪৪ হাজার ৪০৫ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। অপরদিকে ঋণ কমেছে ৮৩৭ কোটি টাকা।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হাসান শেয়ার বিজকে বলেন, যাচাই-বাছাই ছাড়াই ব্যাংকগুলো ঋণ দেয়। তাই ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ে। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও প্রভাবশালীদের হাত থাকে। এজন্য যাচাই-বাছাই করা হয় না।

তিনি আরও বলেন, খেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই। কারণ খেলাপি ঋণের তালিকায় কেউ ঢুকলে দেনদরবার করে বড় হয়ে যায়। এজন্য খেলাপি ঋণ বাড়ে। এছাড়া এ খেলাপিদের দেখাদেখি ভালো গ্রাহকও খেলাপি থেকে উৎসাহ পায়। তারা ভাবে, ঋণ পরিশোধ না করলে তো সমস্যা হয় না। তাই ভালো গ্রাহকরাও খেলাপি হয়ে পড়ে।