নিজস্ব প্রতিবেদক: গত ছয় মাসে জাতীয়, শহর এবং গ্রাম কোনো পর্যায়ে বাড়েনি আয়। কিন্তু এ ছয় মাসে শহর পর্যায়ে খাবারে খরচ বেড়েছে ১৯ শতাংশ, জাতীয়ভাবে ১৭.২ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলে ১৫.৫ শতাংশ বেড়েছে।
গতকাল বুধবার রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত ‘কেমন আছেন নি¤œ আয়ের মানুষ? সানেমের জরিপের ফলাফল’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে জরিপের ফলাফলের এসব তথ্য উপস্থাপন ও বিশ্লেষণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান।
জরিপের ফলাফলে উঠে এসেছে, গত ছয় মাসে একটি পরিবারের খরচ বেড়েছে ১৩.১ শতাংশ। যার মধ্যে গ্রাম এলাকায় ১২.৪ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ১৩.৯ শতাংশ।
সানেমের পক্ষ থেকে আয়োজকরা জানান, বৈশ্বিক ও জাতীয় বিভিন্ন বিষয়ে বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করতে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন। নি¤œ আয়ের মানুষের জন্য এ চ্যালেঞ্জ আরও বেশি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে ব্যয় বৃদ্ধি, যাতায়াতের বর্ধিত খরচ প্রভৃতি বিষয় নি¤œ আয়ের মানুষদের দুর্দশা বাড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে স্বল্প আয়ের পরিবার বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করছেন।
তারা বলেন, এ পরিস্থিতি বাংলাদেশের নিন্ম আয়ের মানুষ কীভাবে মোকাবিলা করছেন এবং সামনের দিনগুলোর বিষয়ে তাদের ভাবনা কী তা বিশদভাবে বোঝার জন্য সানেম নি¤œ আয়ের থানাগুলোর ওপর একটি জরিপ পরিচালনা করেছে। ২০২৩ সালের ৯ থেকে ১৮ মার্চ পর্যন্ত পরিচালিত এ জরিপে ১ হাজার ৬০০ খানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। বাংলাদেশের আটটি বিভাগীয় জেলা ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রামে এ জরিপটি পরিচালনা করা হয়েছে।
জরিপ ফলাফল উপস্থাপন করে সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করছেন কীভাবে এমন প্রশ্ন করেছিলাম আমরা ওইসব সাধারণ মানুষকে। প্রশ্নের জবাবে ৯০.২ শতাংশ পরিবার বলেছে তারা তাদের খাদ্যভাসে পরিবর্তন এনেছেন। ৫৫.৯ শতাংশ বলেছে নন ফুড আইটেমে খরচ কমিয়ে এনেছেন। সঞ্চয় করার সুযোগ কমিয়ে এনেছেন ৫৫.৫ শতাংশ, ওভার টাইম কাজ করছেন ৩৯.৩ শতাংশ, ৩৫.৩ শতাংশ তাদের সঞ্চয় যা ছিল তা থেকে অতিরিক্ত খরচ করছেন।
তিনি আরও বলেন, নি¤œ আয়ের মানুষের সঞ্চয়ের সুযোগ এমনিতেই কম তার ওপর তাদের এ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতিতে। অন্যদিকে শহর এবং গ্রামের মধ্যে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় খাদ্য পরিবর্তন করেছেন ৯৪.৪ শতাংশ আর গ্রামে সেটা ৮৬ শতাংশ। অন্যদিকে, পরিস্থিতি মোকাবিলায় ধার করেছেন শহরের ৭৩.৮ শতাংশ এবং গ্রামের ৭৩.৮ শতাংশ। ধার
করা বন্ধ হয়েছে বা বন্ধ হবে, এমন পরিস্থিতি এখনও আসেনি। বরং পরিস্থিতি যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে ৮৫ শতাংশ পরিবার মনে করে যে আগামী ৬ মাসে তাদের আরও ধার করতে হবে।
বিগত ৬ মাসে ধারের উৎস হিসেবে ৪৫ শতাংশ পরিবার বেছে নিয়েছে ক্ষুদ্র ঋণের প্রতিষ্ঠান। সানেম মনে করে, এ ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের ফলে নি¤œ আয়ের মানুষ সুদের দুষ্টচক্রে পড়ে এবং পরে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। ধার করার জন্য আরও অনেক পথ খুঁজছে মানুষ। এর মধ্যে ৩৭ শতাংশ পরিবার আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। সমবায় সমিতি থেকে ধার করছে ২৩ শতাংশ পরিবার। এছাড়া ব্যাংক ও মহাজনি ঋণ নিয়েছে যথাক্রমে ১৪ ও ৩ শতাংশ পরিবার।
সানেম বলছে, মূল্যস্ফীতির চাপে খাবারের খরচ মেটাতে মানুষ এখন ব্যাপক কাটছাঁট করে চলছে। জরিপে অংশ নেয়া ৯০ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হয়েছে। এর মধ্যে ৯৬ শতাংশ পরিবার মাংস খাওয়া কমিয়েছে। যেমন ছয় মাস আগেও যেসব পরিবারে মাসে ৪ বার মুরগি খেত, এখন তারা ২ বার মুরগি খায়। মাছ খাওয়া কমিয়েছে ৮৮ শতাংশ পরিবার। এছাড়া ৭৭ শতাংশ পরিবার ডিম ও ৮১ শতাংশ পরিবার ভোজ্যতেল খাওয়া কমিয়েছে।
খাদ্যবহির্ভূত পণ্য এবং সেবায়ও নিন্ম আয়ের মানুষ ব্যাপকভাবে খরচ কমিয়েছে। বিশেষ করে পোশাক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। জরিপের তথ্য বলছে, শহরের নি¤œ আয়ের পরিবার খাদ্য কিনতে বেশি কাটছাঁট করছে। গ্রামের পরিবারগুলো খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে খরচ কমিয়েছে বেশি।
সানেমের জরিপে উঠে এসেছে, ঘরে খাবার আছে কি না, তা নিয়ে নি¤œ আয়ের পরিবারে আগের তুলনায় উদ্বেগ বেড়েছে। ফলে খাবারে বৈচিত্র্য কমেছে। খাদ্যতালিকায় থাকছে মাত্র কয়েকটি পদ। ৩৭ শতাংশ পরিবার বলেছে, তাদের এখন মাঝেমধ্যে কোনো এক বেলা খাবার না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। প্রয়োজনের তুলনায় খাবার কম খাচ্ছে বলে মনে করে ৭১ শতাংশ পরিবার।
জরিপকারীদের কাছে ১৮ শতাংশ পরিবারের লোকজন দাবি করেছেন যে এই ৬ মাসে এমন কিছুদিন গেছে, যেদিন তাদের পুরো দিনও না খেয়ে থাকতে হয়েছে। খাবারের গুণগত মানেও ছাড় দিতে হচ্ছে এসব মানুষের। যার কারণে আগের থেকে কম দামি মাছ-মাংস খেতে হচ্ছে। খাদ্য নিরাপত্তার ভয় বেশি শহরের নি¤œ আয়ের পরিবারে।
সানেম বলছে, জরিপে অংশ নেয়া পরিবারের মধ্যে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আছে মাত্র ৪০ শতাংশ নি¤œ আয়ের পরিবার। এর মধ্যে বেশির ভাগ আছে টিসিবির পরিবার কার্ডধারী। সরকারের অন্য সহায়তা তারা পাচ্ছে না। টিসিবির এই কার্ড প্রাপ্তির হার গ্রামের তুলনায় শহরে বেশি।
জরিপে অংশ নেয়া ৫৬ শতাংশ পরিবার মনে করে, আগামী ছয় মাসে তাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। ৪১ শতাংশ পরিবার এটাও বলছে, ভবিষ্যতে তাদের ভিক্ষা বা সাহায্য নিয়ে চলতে হতে পারে। টিকে থাকার জন্য শহর থেকে গ্রামে যেতে চায় বেশির ভাগ মানুষ।
বর্তমানের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারি উদ্যোগ যথেষ্ট কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে জরিপে অংশ নেয়া অধিকাংশ মানুষ বলেছেন, সরকারের উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। সানেম বলছে, ময়মনসিংহ, উত্তরাঞ্চল ও সিলেটের নিন্ম আয়ের মানুষের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তার ভয় বেশি।
সানেম আরও বলছে, খাবার জোগাড় করতে জমি বিক্রি করে চলতে হতে পারে বলে মনে করে ১৭ শতাংশ নিন্ম আয়ের পরিবার। অবস্থা সামাল দিতে ভবিষ্যতে ঘরের শিশুদের শ্রমে নিযুক্ত করতে হতে পারে বলে ১৯ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে আসায় ২৪ শতাংশ পরিবার মনে করে ব্যয় কমাতে তাদের সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ করতে হতে পারে। মেয়েসন্তানকে দ্রুত বিয়ে দেয়ার কথাও বলছেন অনেকে। ২৫ শতাংশ পরিবার মনে করে বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতে তাদের হাতে এখন আর কোনো সুযোগ অবশিষ্ট নেই। তারা এখন নিরুপায়।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সানেম মনে করে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিতে এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত। দেশে উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি খাদ্য আমদানিতে আরও বেশি কৌশলী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে তারা। একই সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। বাজার তদারকিতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি প্রয়োজনে ব্যবসায়ী সংগঠনদের সঙ্গে নিয়ে বাজার তদারকি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে তারা। এছাড়া বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে বলে জানায় সানেম।
অনুষ্ঠানে সানেমের গবেষণা পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশাসহ অন্য গবেষকরা উপস্থিত ছিলেন।