রহমত রহমান: চার বছর জাহাজ নির্মাণের কাঁচামাল আমদানি করা হয়েছে। ১৬০ বিল অব এন্ট্রিতে আমদানি করা হয়েছে প্রায় ১৯৬ কোটি টাকার কাঁচামাল, যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর প্রায় ৭২ কোটি টাকা। এই কাঁচামাল দিয়ে জাহাজ নির্মাণ করে রপ্তানি করার কোনো প্রমাণ নেই। পরিশোধ করা হয়নি প্রযোজ্য শুল্ককর। কাঁচামালের বন্ডিং মেয়াদ শেষ হয়েছে। প্রতিবছর বার্ষিক নিরীক্ষার নিয়ম থাকলেও পাঁচ বছর প্রতিষ্ঠান নিরীক্ষা হয়নি। বন্ড লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে তিন বছর আগে, কিন্তু লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি। ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার ও অনিয়মের এমন অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানকে দাবিনামা-সংবলিত পৃথক দুটি কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে। এছাড়া অনিয়ম করায় প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিতসহ বাতিলের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেজন্য প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট থেকে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড কর্তৃপক্ষকে এসব নোটিশ জারি করা হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, চট্টগ্রামের পটিয়ায় অবস্থিত ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেড বাংলাদেশি জাহাজ ও নৌযান নির্মাণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড ওয়েস্টার্ন মেরিন গ্রুপের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। ২০০৮ সালে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডকে বন্ড লাইসেন্স দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি বন্ড সুবিধায় পুরোনো জাহাজ ও জাহাজের কাঁচামাল আমদানি করে। পরে তা নিয়ে জাহাজ নির্মাণ করে রপ্তানি করে আসছে। তবে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি খতিয়ে দেখে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট। যাতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বার্ষিক নিরীক্ষা সম্পন্ন করেনি। প্রতিষ্ঠানটির বন্ড লাইসেন্সের মেয়াদ ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর শেষ হয়েছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির কোনো আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম নেই।
প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদন ও আমদানি তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৫০টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে বন্ড সুবিধায় এক কোটি সাত লাখ ৮৭ হাজার ৭৭৯ কেজি জাহাজ নির্মাণের কাঁচামাল আমদানি করেছে, যার শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ১৮৭ কোটি ৯১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৪৯ টাকা, যার ওপর প্রযোজ্য শুল্ককর ৬৯ কোটি ৮১ লাখ ৫১ হাজার ৭০৭ টাকা। এসব কাঁচামালের বন্ডিং মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। কিন্তু এই কাঁচামাল দিয়ে জাহাজ নির্মাণ করে রপ্তানি করা হয়েছে কি না, সে বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে রপ্তানির দলিলাদি দাখিল করা হয়নি। বন্ডিং মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোনো আবেদনও করা হয়নি। প্রতিষ্ঠান এই কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণ করেছে বলে ধারণা করছেন বন্ড কমিশনারেট কর্মকর্তারা।
অন্যদিকে বাংলাদেশ কাস্টমসের এমআইএস ডেটাবেইজ থেকে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালে ১০টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে দুই লাখ ৬৭ হাজার ৩০১ কেজি কাঁচামাল আমদানি করেছে, যার শুল্কায়নযোগ্য মূল্য সাত কোটি ৯৯ লাখ ৮০ হাজার ১৪৫ টাকা, যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর দুই কোটি ২৫ লাখ ৫১ হাজার ৫৮৫ টাকা। এই ১০টি বিল অব এন্ট্রির আওতায় আমদানি করা কাঁচামালের বন্ডিং মেয়াদ রয়েছে। তবে এই কাঁচামাল দিয়ে জাহাজ তৈরি করে রপ্তানি করা হয়েছে কি না, তার কোনো দলিলাদি বন্ড কমিশনারেটকে দেয়া হয়নি। প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় কাঁচামালের বন্ডিং মেয়াদের মধ্যে এই কাঁচামাল দিয়ে জাহাজ তৈরি করে রপ্তানির করার কোন সম্ভাবনা নেই বলে প্রতীয়মান হয়।
সূত্রমতে, কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণ ও বন্ডিং মেয়াদ বৃদ্ধি না করায় প্রতিষ্ঠানটি কাস্টমস আইন ও বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সিং বিধিমালা অনুযায়ী বন্ড সুবিধার অপব্যবহার ও অনিয়ম করেছে। সেজন্য প্রতিষ্ঠানকে মোট ১৬০টি বিল অব এন্ট্রির আওতায় আমদানি করা কাঁচামালের প্রযোজ্য শুল্ককর পরিশোধে দাবিনামা-সংবলিত পৃথক দুটি কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেছে। সম্প্রতি এই নোটিশ জারি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ জারির ১৫ দিনের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে। অন্যথায় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে নোটিশে বলা হয়েছে।
অন্যদিকে, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদ নিরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়নি। ‘বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সিং বিধিমালা, ২০০৮’ এবং এনবিআরের আদেশ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানকে প্রতি বছর নিরীক্ষা করার বিধান রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি গত চার বছরে নিরীক্ষা সম্পন্ন করেনি। নিরীক্ষা করতে কোনো দলিল দাখিল করেনি। আইন অমান্য করায় লাইসেন্সিং বিধিমালার শর্ত ভঙ্গ করলে লাইসেন্স স্থগিত করার বিধান রয়েছে। কাস্টমস আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল করার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে। সম্প্রতি এই নোটিশ জারি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের চেয়ারম্যান মো. সাইফুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘মামলা হয়েছে কি না, জানি না। দেখতে হবে।’ কাঁচামাল আমদানি করে জাহাজ তৈরি করে রপ্তানি করা হয়নি। এই বিষয়ে তিনি বলেন, ‘রপ্তানি তো সব জাহাজ হয়েছে। একটা জাহাজ বাকি আছে।’