ফরহাদ জাকারিয়া: উজান থেকে আসা পানিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সম্প্রতি যে বন্যা দেখা দিয়েছে, কয়েক দিনের মধ্যে তা আরও ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। তাদের মতে, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় পানি এ সময়ে গত ১০০ বছরের মধ্যে বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। ১৯ আগস্টের মধ্যে এ পানি বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোয় প্রবেশ করবে। ফলে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় বন্যায় কবলিত হতে পারে দেশ। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ এ অভিমতও ব্যক্ত করেছেন, চীন ও ভারতের নদ-নদীতে যে ধারায় পানি বাড়ছে, তা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি ১৯৮৮ সালের চেয়েও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। অনেকের হয়তো মনে আছে, ওই বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসের এ বন্যার স্থায়িত্ব ছিল ১৫-২০ দিন। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল দেশের প্রায় ৬০ শতাংশেরও বেশি এলাকা। এবার যে বন্যা দেখা দিয়েছে, তার ব্যাপ্তি এখন পর্যন্ত সীমিত রয়েছে কয়েকটি জেলায়। তবে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে যে পূর্বাভাস মিলছে, তাতে কয়েক দিনের মধ্যে নতুন এলাকা প্লাবিত হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এও মনে রাখতে হবে, বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস যদি সত্য হয় অর্থাৎ এবারের বন্যা যদি ১৯৮৮ সালের চেয়ে ব্যাপ্তিতে বড় হয়, তাহলে দেশের ৬০ শতাংশেরও বেশি এলাকা প্লাবিত হবে।
বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ যে কী অপরিসীম, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকলে তা অনুভব করা মুশকিল। মোটা দাগে বললে, যাদের কিছু সহায়-সম্পদ আছে, এ সময় তারাও হয়ে পড়ে অসহায়। আর যাদের কিছু নেই, এ সময়ে তারা পড়ে অবর্ণনীয় ভোগান্তির মুখে। পরিস্থিতিটা এমন ঘরে থাকে না খাবার, বাইরে থাকে না কাজ। এজন্য কোথাও ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে, এমন খবর পেলে সেখানে ছুটতে থাকে মানুষ। লাইন দীর্ঘ হয় ত্রাণগ্রহীতাদের।
প্রশ্ন হলো, এই যে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ছে, তাদের সহায়তা জোগানোর মতো প্রস্তুতি কি আমাদের রয়েছে? অনেকে বলছেন, প্রস্তুতি আছে। কিন্তু বন্যা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে এ প্রস্তুতি দিয়ে কি পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে? বন্যার্তদের সহায়তার প্রস্তুতি বলতে অনেকে শুধু খাদ্যের মজুতকে বোঝেন। মনে রাখতে হবে, এ সময় পানিবাহিত রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষায় বেশ কিছু ওষুধও প্রয়োজন হয়। সেসব ওষুধ কি আমাদের মজুত রয়েছে পর্যাপ্ত? সেগুলো যথাসময়ে মানুষের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা কি রয়েছে? এও মনে রাখা দরকার, এসব যথাসময়ে সরবরাহ করা না গেলে পানিবাহিত রোগের প্রভাব মোকাবিলা করাটা মুশকিল হবে। গত কয়েক দিনে যেসব এলাকা প্লাবিত হয়েছে, সেখানে প্রাণহানি ততটা ব্যাপক হয়নি। তবে এটা যথাযথভাবে সামলানো না গেলে প্রাণহানি বেড়ে উঠতে পারে।
দুই
হাওরাঞ্চলের ধান বন্যায় নষ্ট হওয়ার পর থেকেই দেশের চালের বাজার হয়ে উঠেছে অস্থিতিশীল। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য কয়েকটি দেশের সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে আমদানি চুক্তি সম্পাদন হয়েছে এর মধ্যে। বেসরকারি পর্যায়ে আমদানিকারকদের উৎসাহ জোগানোর জন্য শুল্ক কমানো হয়েছে ১৮ শতাংশ। এসব চাল খুচরা পর্যায়ে পৌঁছলেও দামে তেমন প্রভাব পড়েনি। এর একটা কারণ হলো, চাল উৎপাদনে ওপরের দিকে থাকা বাংলাদেশ আমদানিকারকে পরিণত হওয়ায় পরিস্থিতি বুঝে রফতানিকারক দেশগুলো দাম কিছুটা বাড়িয়েছে। চীন ও ভারতে দীর্ঘমেয়াদি বন্যার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে, এর প্রভাব চালের আন্তর্জাতিক বাজারে পড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। সম্প্রতি সরকার যেসব দেশের সঙ্গে চাল আমদানির চুক্তি সম্পাদন করেছে, পরিস্থিতি বিবেচনায় তারা যদি আরও বেশি দাম দাবি করে, তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। অর্থাৎ এ অঞ্চলের দীর্ঘমেয়াদি বন্যার পূর্বাভাস আগামী কয়েক মাসের জন্য চালের আন্তর্জাতিক বাজারকে একটা অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেবে বলেই মনে হচ্ছে।
বাস্তবতা হলো, কোনো আমদানি পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়লে তার প্রভাব পড়ে স্থানীয় বাজারে। সে পরিস্থিতিতে দেশের চালের বাজারেও সৃষ্টি হতে পারে অস্থিতিশীলতা। বস্তুত হাওরাঞ্চলের ধান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর অনেকে ধারণা করেছিলেন, আমন ঘরে উঠলে শঙ্কা হয়তো অনেকটা কেটে যাবে। বাংলাদেশে বন্যা এবার দীর্ঘস্থায়ী হলে প্লাবিত অঞ্চলের অনেক কৃষকই কিন্তু আমন ধান ঘরে তুলতে পারবেন না। চালের বাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির পেছনে এটাও হবে অন্যতম উপাদান।
এ অবস্থায় বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায় হলো, সরকারি পর্যায়ে মজুত বাড়ানো। তবে এ ব্যাপারে হালনাগাদ যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, সেটা উদ্বেগজনক। বহুল প্রচারিত একটি জাতীয় দৈনিকে ১৩ আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত দুই মাসে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সরকারি গুদামে চাল এসেছে মাত্র ৫৭ হাজার মেট্রিক টন। আর ১৭ লাখ টন ধারণক্ষমতার সরকারি গুদামে মজুত আছে মাত্র দুই লাখ ৭৩ হাজার মেট্রিক টন। এ থেকেই বোঝা যায়, পরিস্থিতি কতটা খারাপ। নীতিনির্ধারকদের মনে রাখতে হবে, বন্যা দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যাপক আকার ধারণ করলে ত্রাণ হিসেবে চালের চাহিদাই শুধু বাড়বে না; বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় থাকা মানুষকেও এটা জোগাতে হবে খাবারের জন্য। এটা অব্যাহত রাখতে হবে বন্যা শেষ হওয়ার পরও। চাল যদি প্রত্যাশিত পরিমাণে আমদানি করা না যায়, তাহলে এসব কর্মসূচিই শুধু বন্ধ হবে না, যাদের হাতে টাকা আছে, তাদেরও হিমশিম খেতে হবে চাহিদা অনুযায়ী পেতে।
চাল আমদানি বৃদ্ধিতে সরকারের পক্ষ থেকে যে তৎপরতা দেখানো হচ্ছে, সেটাকে ইতিবাচকই বলতে হবে। দেখা গেছে, শীর্ষ রফতানিকারক কয়েকটি দেশে সরকারের প্রতিনিধিরা সফর করেছেন এবং সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করেছেন। দ্বিতীয় দফায় আরও পাঁচ শতাংশ আমদানি শুল্ক হ্রাসের সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু কথা হলো, যে পদক্ষেপই নেওয়া হোক না কেন, চাল বাজারে না এলে এবং সেখানে সরকারের তদারকি যথাযথভাবে না থাকলে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হবে না। এ প্রক্রিয়া যত দীর্ঘ হবে, সেখান থেকে ফায়দা নেবে অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা। তাতে শুধু বন্যাদুর্গত নয়, ভুগতে হবে এর বাইরে থাকা সাধারণ মানুষকে।
তিন
সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দেশে উদ্যাপিত হবে ঈদুল আজহা। এ উৎসব ঘিরে চলতি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে গ্রামে ফিরতে শুরু করবে মানুষ। বন্যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মহাসড়ক ও রেলপথ হয়েছে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এখনও ঢাকার সঙ্গে এ দুই পথে যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে কোনো কোনো জেলার। সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলে মানুষকে সাধারণত দেখা যায় রেলপথযাত্রী হতে। কিন্তু যেসব এলাকার রেলপথ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো যদি উল্লিখিত সময়ে মেরামত করা না হয়, তাহলে মানুষ হয়ে উঠবে নিরুপায়। সব মিলিয়ে বোঝাই যাচ্ছে, কত কষ্টকর হতে পারে এবারের ঈদে গ্রামে ফেরা। সংবাদপত্রে দেখেছি, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন ২৫ আগস্টের মধ্যে সব সড়ক ও মহাসড়ক ঠিকঠাক করতে। কিন্তু বাস্তবে তা কতটা হবে, কে জানে! সংশ্লিষ্টরা যদি আন্তরিক হনও, পানিতে ডুবে থাকা ক্ষতিগ্রস্ত মহাসড়ক তারা মেরামত করবেন কীভাবে?
আবার শোনা যাচ্ছে, ঈদের ছুটি ছয় দিন করার ব্যাপারে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দীর্ঘদিন থেকে যে দাবি ছিল, সেটা কার্যকর হতে যাচ্ছে এবার। অনেকে বলেন, ঈদে ছুটি বেশি দিন হলে মানুষের দুর্ভোগ কমে। কিন্তু কথা হলো, এবার ছুটি এমনভাবে পড়েছে যে, ঈদ শেষ হলেই সোমবার থেকে শুরু হবে অফিস। কেউ না আসতে চাইলে তাকে ছুটি নিতে হবে। ছুটি না পেলে অনেকেই হয়তো থেকে যাবেন নিজ কর্মস্থলে। এ অবস্থায় যদি ছয় দিনের ছুটি কার্যকর করা হয়, তাহলে মানুষকে কিন্তু ধরে রাখা যাবে না। সড়কের এ নাজুক পরিস্থিতিতে বাড়তি ছুটি দিয়ে তাকে গ্রামে ফিরতে উৎসাহ জোগানো নীতিগতভাবে সুবিবেচনাপ্রসূত হবে বলে মনে হয় না। কর্মীদের সুবিধা বিবেচনায় রেখে সরকার যদি এটা করতেই চায়, তাহলে সেটা পরে কার্যকর করাই হবে সুবুদ্ধির পরিচায়ক।
চার
বন্যা দীর্ঘমেয়াদি হলে তা কতদিন স্থায়ী হতে পারে? বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যে অবশ্য এ ব্যাপারে কোনো পূর্বাভাস পাওয়া যায়নি। ১৯৮৮ সালের বন্যার সমান স্থায়িত্ব হলেও সেটা চলে যাবে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। তবে মনে রাখতে হবে, পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গেই এর প্রভাব শেষ হয় না। বন্যাকবলিত মানুষের ঘরে এর প্রভাব ও ক্ষতচিহ্ন থাকে অনেক দিন। এ দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যেসব প্রস্তুতি নেওয়া হবে, সেগুলো নিতে হবে ওই সময় বিবেচনায় রেখেই। ১৯৮৮ কিংবা ১৯৯৮ সালের বন্যাকালে আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ছিল অপেক্ষাকৃত কম। আমাদের দেশ তখন ছিল বিদেশি সহায়তানির্ভর। এখন পরিস্থিতি সে রকম নেই। নীতিনির্ধারকদের সদিচ্ছা ও যথাযথ ধারায় প্রচেষ্টা থাকলে নিজেদের অর্থ ও সক্ষমতা সদ্ব্যবহার করে কিছু প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে যেসব উপাদান সক্রিয় হয়ে উঠেছে, তা এ পরিস্থিতি মোকাবিলাকে কিছুটা হলেও কঠিন করবে। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত হবে সহায়তার জন্য বিশেষ কোনো দেশের দ্বারস্থ না হয়ে বাণিজ্য সম্প্রসারণমূলক যেসব আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্লাটফর্ম রয়েছে, সেগুলোকে কাজে লাগানো।
ভৌগোলিকভাবেই বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত। এজন্য এখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানে মাঝেমধ্যে। উন্নয়নের নানা মানদণ্ডে আমরা যখন এগিয়ে যাচ্ছি, একে টেকসই করার কথা বলছি, তখন দুর্যোগ মোকাবিলার ব্যাপারেও দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতির বিষয় কি আমাদের ভাবতে হবে না? নাকি একেকটি দুর্যোগ আঘাত হানবে আর আমরা অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকব দাতাগোষ্ঠীর দিকে? এভাবেই চলতে থাকবে অনন্তকাল? শুধু সরকারি গুদামে চালের মজুত স্বাভাবিক থাকলে এ দুর্যোগের নেতিবাচক প্রভাব অর্ধেকটা কমানো যেতো বলে অনেকে মনে করেন। সেই প্রস্তুতিই বা কেন ছিল না? নীতিনির্ধারকরা যদি এসব বিষয়ে আন্তরিকতাসহ ভাবেন, তাহলে সম্ভাব্য দুর্যোগের প্রভাব অনেকটাই কমানো যাবে। মানুষের ভোগান্তিও কমবে। কারণ আর কেউ না হোক, সরকার তো থাকবে তার পাশে পর্যাপ্ত সহায়তা নিয়ে। এমন স্বস্তিতেই তো থাকতে চায় দেশের মানুষ।
ব্যাংক কর্মকর্তা