প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

 রমজানে চিনির মূল্য বৃদ্ধি কতটুকু যৌক্তিক

 

নিতাই চন্দ্র রায়: বিশ্ববাজারে গত চার মাসে চিনির দাম ১৯ শতাংশ কমলেও বাংলাদেশে গত এক মাসে চিনির দাম বেড়েছে ১৬ শতাংশ। এ বছর চিনির দাম বাড়তে শুরু করে রোজার এক মাস আগে থেকে। টিসিবির হিসাব অনুযায়ী, রোজার এক মাস আগে বাজারে প্রতি কেজি চিনির দাম ছিল ৬২ থেকে ৬৫ টাকা। সে চিনিই এখন প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭২ টাকা দরে।

আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম কমলেও রমজানকে পুঁজি করে দেশে কারসাজির মাধ্যমে বাড়ানো হচ্ছে চিনির দাম। এ কারসাজির সঙ্গে একশ্রেণির পরিশোধন কারখানার মালিক ও চিনি ব্যবসায়ীরা জড়িত বলে মনে করে অভিজ্ঞ মহল। রমজানে অন্য মাসের তুলনায় চিনির চাহিদা থাকে বেশি। সাধারণত প্রতি মাসে চিনির চাহিদা এক থেকে সোয়া লাখ টন হলেও রমজানে চিনির চাহিদা থাকে ২ লাখ ৫০ হাজার টন। সারা দিনের পিপাসা ও ক্লান্তি দূর করার জন্য রোজাদাররা ইফতারির সময় শরবত পান করেন। এছাড়া জিলাপি, বুন্দিয়াসহ নানা রকম মিষ্টিজাতীয় ইফতারি আইটেম তৈরি করতে প্রচুর চিনির প্রয়োজন হয়। মস্তিষ্কের উপযুক্ত বিকাশ ও পূর্ণ কার্যকারিতার জন্য চিনি একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। বিশেষ করে মেধাশক্তি বিকাশে এর বিকল্প নেই। জাতিসংঘের নির্ধারিত মান অনুযায়ী বার্ষিক জনপ্রতি ১৩ কেজি চিনি বা গুড় খাওয়া প্রয়োজন। সে হিসেবে ১৬ কোটি ১৭ লাখ মানুষের বার্ষিক চিনি ও গুড়ের প্রয়োজন প্রায় ২১ লাখ টন। প্রতিবছর সারা দেশে আখ, খেজুর, তাল ও গোলপাতা থেকে গুড় উৎপাদিত হয় আনুমানিক ৬ লাখ টন। বাকি ১৫ লাখ টন মিষ্টিজাতীয় দ্রব্যের চাহিদা আমাদের চিনির মাধ্যমেই পূরণ করতে হয়। দেশের ১৫টি সরকারি চিনিকলের বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা ২ লাখ ১০ হাজার টন হলেও মিল জোন এলাকায় পাওয়ার ক্রাশারের মাধ্যমে অবৈধভাবে গুড় তৈরি এবং পর্যাপ্ত আখ চাষ না হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চিনি উৎপাদন সম্ভব হয় না। সদ্যসমাপ্ত ২০১৬-১৭ মাড়াই মৌসুমে ১৫টি সুগার মিলে চিনি উৎপাদন প্রায় ৬০ হাজার টন, গত বছর অর্থাৎ ২০১৫-১৬ মাড়াই মৌসুমে চিনি উৎপাদন হয়েছিল ৫৮ হাজার টন এবং এর আগের মাড়াই মৌসুমে চিনি উৎপাদিত হয়েছিল ৭৭ হাজার টন। গত তিন বছরে গড়ে চিনি উৎপাদিত হয় প্রায় ৬৫ হাজার টন। সে হিসেবে দেশে চাহিদা পূরণের জন্য প্রতিবছর ১৫ থেকে ১৬ লাখ টন চিনি আমদানি করতে হয়। এসব চিনির সিংহভাগ আমদানি করে ৫টি চিনি পরিশোধন কারখানা।

সংগত কারণে দেশের চিনির ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে বেসরকারি খাতের ওই পাঁচটি চিনি শোধনাগার। দেখা গেছে, সরকারি গুদামে যখন বেশি চিনি মজুত থাকে, তখন এসব পরিশোধন কারখানা সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে চিনি বিক্রি করে। সরকারি চিনিকলের উৎপাদিত চিনি অবিক্রীত হয়ে পড়ে থাকে। তহবিলের অভাবে চিনিকলগুলোর পক্ষে সময়মতো চাষিদের আখের মূল্য এবং শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ সম্ভব হয় না। আবার সরকারি চিনিকলগুলোর গুদামে যখন চিনি মজুত কম থাকে অথবা রোজার সময়ে যখন চিনির চাহিদা বেড়ে যায়, তখন এসব পরিশোধন কারখানগুলো মেরামতের নামে চিনি উৎপাদন বন্ধ রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ভোক্তাদের পকেট থেকে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এ বছর রমজান মাসেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

বর্তমানে টনপ্রতি অপরিশোধিত চিনির সর্বমোট আমদানি শুল্ক ৭ হাজার টাকা ও পরিশোধিত চিনির শুল্ক সাড়ে দশ হাজার টাকা। খাতুনগঞ্জের চিনি ব্যবসায়ীরা মনে করেন, পরিশোধিত ও অপরিশোধিত চিনি আমদানির মধ্যে শুল্ক ব্যবধান কমিয়ে আনা গেলে কারসাজি বন্ধ হবে। রমজানের আগে মেরামতের নামে কারখানা বন্ধ রাখার কৌশল থাকবে না। উৎপাদনক্ষমতার অতিরিক্ত ডেলিভারি অর্ডার বিক্রি এবং মাসের পর মাস চিনির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার সব অপকৌশল বন্ধ হয়ে যাবে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে ১৬ লাখ টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি করা হয়েছে। এর বাইরে পরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে ১১ হাজার টন। আগের অর্থবছরের একই সময়ে অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছিল ১১ লাখ ২৬ হাজার টন। আমদানি গত বছরের চেয়ে সাড়ে চার হাজার টন বেশি হওয়ার পরও কারসাজি করে চিনির বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। বন্দরের হিসাবে গত ১০ মাসে আমদানিকৃত মোট চিনির ৩৫ শতাংশ এনেছে মেঘনা গ্রুপ, প্রায় ৩১ শতাংশ এনেছে সিটি গ্রুপ এবং এস আলম ও আবদুল মোনেম গ্রুপ এনেছে ১০ শতাংশ করে। কয়েক বছর ধরেই চিনি আমদানির শীর্ষে রয়েছে মেঘনা, সিটি ও এস আলম গ্রুপ। গত রমজানে মেরামতের নামে তিনটি প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে কারসাজি করে বন্ধ রাখা হয়েছিল।

গত দুই বছরের হিসেবে দেখা যায় যে, দেশে ব্যবহƒত চিনির ৯৫ শতাংশ সরবরাহ করে ৫টি পরিশোধন কারখানা, ৪ দশমিক ৩ শতাংশ সরবরাহ করে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন এবং বাকি দশমিক ৭ শতাংশ সরবরাহ করা করা হয় পরিশোধিত চিনি আমদানির মাধ্যমে।

রমজান মাসে দেশে প্রতিদিন চিনির চাহিদা আনুমানিক ৮ হাজার ৩৫০ টন। পরিশোধন কারখানাগুলোর ভাষ্যমতে, ৫টি পরিশোধন কারখানা প্রতিদিন তাদের মিলগেটে ৫৮ টাকা কেজি দরে ৬ থেকে ৭ হাজার টন চিনি সরবরাহ করছে। এস আলম গ্রুপ প্রতিদিন চট্টগ্রামের ৩৮টি পয়েন্টে প্রতি কেজি ৫৮ টাকা দরে ১ হাজার টন করে চিনি বিক্রি করছে। এছাড়া ঢাকা শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে ৫টি রিফাইনারি কারখানা ৬০ টাকা কেজি দরে প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি করছে। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন তাদের তালিকাভুক্ত ডিলারদের মধ্যে ৬০ টাকা কেজি দরে চিনি বিক্রি করছে। সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের রেশনের জন্য বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন প্রয়োজনীয় চিনি বরাদ্দ দিচ্ছে। এছাড়া রমজান মাসে চিনির দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে রাজধানীর মতিঝিলে চিনিশিল্প ভবনের নিচতলাসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে প্রতি কেজি ৬৫ টাকা হিসেবে আখ থেকে উৎপাদিত দেশি প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি করা হচ্ছে। অন্যদিকে স্থানীয় ভোক্তাদের চাহিদা মেটানোর জন্য ১৬টি চিনিকল তাদের আশপাশের শহরগুলোয় সরকার নির্ধারিত মূল্যে প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি অব্যাহত রাখছে। এ অবস্থায় দেশে চিনির মূল্য এক মাসের ব্যবধানে ১০ থেকে ১২ টাকা বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে না। এটা একশ্রেণির ব্যবসায়ী ও পরিশোধন কারখানার মালিকদের ব্যবসায়ী অপকৌশল ছাড়া কিছু নয় বলে মনে করে সংশ্লিষ্ট মহল।

রোজার আগে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন অপরিশোধিত চিনির দাম ছিল ৪০৯ ডলার। সেই হিসাবে টাকার অঙ্কে প্রতি কেজি চিনির দাম পড়ে ৩৩ টাকা ১২ পয়সা। এর সঙ্গে টনপ্রতি সর্বমোট আমদানি শুল্ক ৭ হাজার টাকা, পরিবহন ও পরিশোধন খরচ যোগ দিলে প্রতি কেজি চিনির দাম ৫০ থেকে ৫৫ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। অথচ ওই চিনি ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে ৭০ থেকে ৭২ টাকা কেজিতে।

শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়–য়ার সময়ে একবার বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের মাধ্যমে ৬০ হাজার টন চিনি আমদানি করা হয়। তিনবার চিনির দাম কমিয়েও সেই চিনি বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। পরে ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে আমদানিকৃত চিনি সংগ্রহমূল্যের অর্ধেক দামে বিক্রি করা হয়। এর পেছনেও ছিল পরিশোধন কারখানাগুলোর কম মূল্যে চিনি বিক্রির অপকৌশল।

পরিশোধন কারখানগুলো চিনি নিয়ে কী রকম কারসাজি করছে, তা ত্রিশালের একজন চিনি ব্যবসায়ীর ভাষ্য থেকেই  বোঝা যায়। ময়মনসিংহের ত্রিশাল পৌর বাজারের চিনির পাইকারি ব্যবসায়ী জীবন স্টোরের মালিক কাজল চন্দ্র মোদক মেঘনা গ্রুপের কারখানা থেকে গত ৩০ এপ্রিল প্রতি টন ৫৯ হাজার ২৪০ টাকা দরে ১৬ টন চিনির ডিও কেনেন। তাকে মেঘনা গ্রুপ প্রায় এক মাস পর ৫ জুন তারিখে চিনি সরবরাহ করে। এজন্য ব্যবসায়ী কাজল চন্দ্রকে ১৮ হাজার ৫০০ টাকা অতিরিক্ত ট্রাক ভাড়া পরিশোধ করতে হয় এবং ব্যাংকের এক মাসের অতিরিক্ত সুদ গুনতে হয় প্রায় ১২ হাজার টাকা। এভাবে যদি চিনি সরবরাহে অযথা বিলম্ব করা হয়, তাহলে ব্যবসায়ীরা কীভাবে কম মূল্যে ভোক্তাদের মধ্যে চিনি বিক্রি করবেন?

চিনির মতো একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ব্যাপারে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর অতিনির্ভরশীলতা কমানোর জন্য অমৌসুমে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে ‘র’ সুগার থেকে ৪০ হাজার টন চিনি উৎপাদনের যে প্রকল্পের কাজ চলছে, তা নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করতে হবে। সেই সঙ্গে ঠাকুরগাঁও সুগার মিলে সুগারবিট ও ‘র’ সুগার থেকে চিনি উৎপাদনের প্রকল্পটিও যথাসময়ে সম্পন্ন করা গেলে সরকারিভাবে চিনির বাজারমূল্য কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। এছাড়া জনস্বার্থে চিনির মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য আন্তর্জাতিক মূল্য, আমদানি, মজুত, পরিশোধন, সরবরাহ ও বাজারদর নিয়মিত মনিটরিং করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ আরও জোরদার করতে হবে।

 

সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড

netairoy18Ñyahoo.com