খন্দকার আপন হোসাইন : মানুষের অস্তিত্ব মানেই এক দ্বন্দ্বযাত্রা। এই দ্বন্দ্বযাত্রা আলো আর অন্ধকারের। এই দ্বন্দ্বযাত্রা আশা আর হতাশার। এই দ্বন্দ্বযাত্রা বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষা আর মৃত্যুর প্রলোভনের। একদিকে সভ্যতার ইতিহাস নির্মিত হয়েছে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও অগ্রগতির বর্ণিল ইট দিয়ে। অপরদিকে সভ্যতার ইতিহাস রচিত হয়েছে মানুষের অন্তর্লোকের গভীর অস্থিরতা, অদৃশ্য শূন্যতার বেদনাবাহী ছায়া দিয়ে। পৃথিবী আজ অভূতপূর্ব প্রাচুর্যের যুগে প্রবেশ করেছে। তবুও এক অদৃশ্য বিষণ্নতার নদী ক্রমাগত ভাসিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ জীবন। এই অদ্ভুত পরস্পরবিরোধী দৃশ্যপটের ভেতরেই লুকিয়ে আছে সময়ের ট্র্যাজেডি। যান্ত্রিক সাফল্যে মানুষের উচ্ছ্বসিত উল্লাস। এই উল্লাসের আড়ালে নীরবে বেড়ে উঠছে এক অন্ধকার বাগান। যেখানে প্রতিদিন ফুটে ওঠে অবসাদের কালো ফুল। বিষাক্ত পরাগ থেকে জন্ম নেয় আত্মহত্যার নিষ্ঠুর বাস্তবতা। পরিসংখ্যানের ভাষা বলে, শত মানুষের ভিড়ে অন্তত একজন এই অন্ধকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু প্রতিটি মৃত্যুর ভেতরই তো লুকিয়ে থাকে এক অপূর্ণ কবিতা, এক ছিন্ন প্রেমপত্র, এক অসমাপ্ত স্বপ্ন। আত্মহত্যা কি কেবল একজন মানুষের বিদায় নাকি সভ্যতার নীরব আর্তনাদ নাকি যুগের গোপন লজ্জা। সমাজের অক্ষমতা, পরিবারের অবহেলা, রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতা সব মিলিয়েই অদৃশ্য ফাঁস গলায় বেঁধে যায় অসংখ্য তরুণ-তরুণীর। অথচ প্রতিটি মানুষই জš§ নেয় অনন্ত সম্ভাবনা নিয়ে। প্রশ্ন হলো আমরা কি সেই সম্ভাবনাকে রক্ষা করতে পারছি?
মানুষের অন্তর্জগতের অন্ধকারে দুঃখ, বেদনা, সামাজিক চাপ ও নিঃসঙ্গতা মিলে তৈরি হয় গভীর গহ্বর। বিশ্ব আজ এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তির বিস্ফোরণ, অর্থনীতির উল্লম্ফন, ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রসার হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের মাঝেই লুকিয়ে আছে বিষাদ। পৃথিবীতে আজ ১০০ কোটিরও বেশি মানুষ অবসাদের অন্ধকারে ডুবে আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্র্রতিক তথ্য বলছে প্রতি ১০০ জনে একজন আত্মহত্যার প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। ২০১১ সালে ৭ থেকে ৮ লাখেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যার কারণে প্রাণ হারিয়েছিল। প্রতি ২০টি চেষ্টার মধ্যে একটি চেষ্টা জীবনহানি ঘটিয়েছে। এই পরিসংখ্যান কি কেবলই সংখ্যা? না। প্রতিটি সংখ্যার পেছনে আছে একেকটি গল্প। গল্প আছে ভাঙা আশার, ছিন্ন মমতার, নিভে যাওয়া আলোর। এই সংখ্যা সভ্যতার মুখে তীব্র প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। মানবজাতি এত উন্নত চিত্তের হয়েও কেন নিজের অন্তরকে সামলাতে পারছে না? পারছে না কারন মানসিক ব্যাধিতে ছেয়ে যাচ্ছে চতুর্দিক। মানসিক ব্যাধির বিস্তার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। ২০১১ থেকে ২০২১ এই এক দশকে বিশ্বব্যাপী মানসিক ব্যাধির হার ১৩ দশমিক ৬ শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ প্রায় প্রতিটি সমাজেই অদৃশ্য ঝড় বইছে। সে ঝড়ে তরুণ ও যুবকরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। ২০ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে মানসিক ব্যাধির প্রকোপ ১ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। যে প্রজš§ আগামীর চালিকাশক্তি তারাই সবচেয়ে বিপন্ন।
পুরুষদের মধ্যে প্রায়ই দেখা যায় মনোযোগ-ঘাটতি, অতি-সক্রিয়তা ব্যাধি কিংবা বুদ্ধিবিকাশের জটিলতা। নারীদের মধ্যে উদ্বেগ ও হতাশা বেশি প্রবল। গবেষণায় দেখা যায়, উদ্বেগজনিত সমস্যা সাধারণত কম বয়সেই শুরু হয়। ১০ বছরের আগে তা বিরল, কিন্তু একবার শুরু হলে ক্রমে বেড়েই চলে। আর চল্লিশোর্ধ্ব বয়সে হতাশার ছায়া আরও ঘন হয়। পঞ্চাশ থেকে ঊনসত্তরের মধ্যে হতাশা সবচেয়ে প্রকট রূপ নেয়। বাংলাদেশও এই বৈশ্বিক প্রবণতার বাইরে নয়। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্যানুসারে, দেশে প্রায় ১৭ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশই কিশোর ও তরুণ। আত্মহত্যার ঘটনাও বাংলাদেশে ভয়ংকর হারে বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, স্কুলপড়ুয়া কিশোরী কিংবা প্রবাস ফেরত যুবক প্রায়ই সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়। মানসিক যন্ত্রণার ভার তারা বহন করতে পারে না। ফলে একমাত্র সমাধান মনে হয় মৃত্যু। সামাজিক পরিসংখ্যান ভিন্ন কিছু বলে না। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, আত্মহত্যায় মৃত্যুর হার বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে বিশ্ব গড়ের চেয়ে বেশি। যে বয়সে জীবনের গান গাওয়ার কথা, সে বয়সে তারা বিদায়ের সুর তোলে। আর্থিক চাপ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, সামাজিক অবহেলা, প্রেমঘটিত জটিলতা এসবকিছুই গড়ে তোলে এক গভীর অন্ধকার। জাতিসংঘ ২০৩০ সালের মধ্যে আত্মহত্যার হার এক-তৃতীয়াংশ কমানোর লক্ষ্য নিয়েছে। কিন্তু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট বলছে অগ্রগতি খুবই নগণ্য। যদি বর্তমান গতি অব্যাহত থাকে, তবে ২০৩০ সালের মধ্যে আত্মহত্যা সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ কমতে পারে। অর্থাৎ লক্ষ্য অনেক দূর। পথ আরও কঠিন।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অব ইন্ডিয়ার পরিচালক ডা. প্রতিমা মূর্তি আত্মহত্যার নানা কারণ বিশ্লেষণ করেছেন। বিশ্লেষণে এসেছে ঝুঁকি, দুর্বল মানসিকতা, শৈশবে আঘাত, সামাজিক চাপ, বিচ্ছিন্নতা, সহানুভূতির অভাব ইত্যাদি কারণে মানুষ ভেঙে পড়ে। সাহায্যের অভাব, পরিষেবার অপ্রাপ্যতা ও কলঙ্কের সংস্কৃতি সমস্যা আরও ঘনীভূত করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এখানে এখনও একধরনের নীরব নিষেধাজ্ঞা কাজ করে। পরিবার অনেক সময় মানসিক অসুস্থতাকে ‘লজ্জার’ বিষয় বলে মনে করে। ফলে রোগী সঠিক চিকিৎসা পায় না। মানসিক হাসপাতালে শয্যার অভাব, ডাক্তার ও নার্সের ঘাটতি প্রকট। পুরো দেশে প্রশিক্ষিত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আছেন অতি অল্প। প্রতি লাখে একজনও নেই। অথচ আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব। আইসল্যান্ড, জাপান কিংবা অস্ট্রেলিয়া দেখিয়েছে, কৌশলগত পরিকল্পনা ও সচেতনতা বাড়ালে মৃত্যুহার কমানো যায়। জাপান একসময় আত্মহত্যার জন্য কুখ্যাত ছিল। কিন্তু সরকার ‘গেটিং লাইফ ব্যাক’ নামে জাতীয় কর্মসূচি চালু করার পর হার প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। বাংলাদেশও চাইলে এমন উদ্যোগ নিতে পারে। এক্ষেত্রে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষার প্রয়োজন। শিশুদের শেখাতে হবে অবসাদ কোনো দুর্বলতা নয় এটি একটি অসুখ। যেমন জ্বর হলে চিকিৎসা লাগে, তেমনি মন খারাপ হলে সহায়তা চাইতে হয়। শিক্ষক, অভিভাবক ও সমাজকর্মীরা যদি একসঙ্গে কাজ করেন, তবে অন্তত কিশোরদের অনেকটা রক্ষা করা যাবে।
অর্থনৈতিক চাপও একটি বড় কারণ। বেকারত্ব, আয় বৈষম্য ও জীবনযাত্রার ব্যয়মান বৃদ্ধি মানুষকে হতাশ করে। বাংলাদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ সীমিত। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণরা কাজ খুঁজে না পেয়ে আত্মমর্যাদাবোধ হারায়। তারা মনে করে জীবন অর্থহীন। এই সংকট সমাধানে সরকারকে নীতি পরিবর্তন করতে হবে। এছাড়া গণমাধ্যমের দায়িত্বও অপরিসীম। টেলিভিশন ও মোবাইল নেটওয়ার্ক ভোগবাদ ও প্রতিযোগিতার বার্তা ছড়ায়। সবাইকে দেখায় সুখ মানেই বেশি ভোগ। কিন্তু ভোগ তো কখনই পূর্ণ হয় না। আশার অপূর্ণতা হতাশায় রূপ নেয়। গণমাধ্যমকে তাই সচেতন হতে হবে। তাদের উচিত আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনের সময় সংবেদনশীলতা বজায় রাখা, মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং ইতিবাচক বার্তা ছড়ানো। মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই আসলে এক অনন্ত সম্ভাবনার দিগন্ত। তবু কখনও কখনও সেই দিগন্তে নামতে থাকে ছায়া, ভেসে আসে অন্ধকারের ঢেউ। অবসাদ, নিঃসঙ্গতা আর অবহেলার বোঝা মানুষকে ঠেলে দেয় এমন এক প্রান্তে, যেখানে আলো ম্লান হয়ে আসে। কিন্তু সত্য হলো অন্ধকার চিরন্তন নয়। রাত শেষেই উšে§াচিত হয় ভোরের আলোকচ্ছটা। আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয় বরং তা এক সভ্যতার শূন্যতায় ডুবে যাওয়ার করুণ চিহ্ন। একটি জীবন নিভে যাওয়া মানে কেবল একজন মানুষের অনুপস্থিতি নয়। একটি আত্মহত্যা একটি পরিবারের অনন্ত শোক, একটি সমাজের গভীর ক্ষত, একটি রাষ্ট্রের অকৃতজ্ঞ ইতিহাস। তাই প্রয়োজন আমাদের সম্মিলিত জাগরণ যেখানে পরিবার হবে সহমর্মিতার আঁধার, বিদ্যালয় হবে মানসিক দৃঢ়তার পাঠশালা, রাষ্ট্র হবে নিরাপত্তার ছায়া, আর সমাজ হবে ভালোবাসা ও আশ্রয়ের উš§ুক্ত বন্দর। আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে কেবল বই নয় আশার প্রদীপও তুলে দিতে হবে। তাদের শেখাতে হবে ব্যর্থতা কোনো সমাপ্তি নয়। প্রতিটি অশ্রুবিন্দুর ভেতরেই লুকিয়ে আছে নতুন আলোর সম্ভাবনা। অন্ধকারকে পরাজিত করার মাঝেই রয়েছে নবজীবনের সুর পুনর্লিখন। তাদের শেখাতে হবে এমন এক পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব যেখানে কেউ নিজের দুঃখের ভারে একা ভেঙে পড়বে না বরং পাবে সহমর্মিতা আর ভালোবাসার উষ্ণতা। কবি যেমন বলেন, ‘মানুষ বাঁচে তার স্বপ্নের ভেতর।’ সেই স্বপ্ন রক্ষা করতে পারলে একদিন হয়তো সত্যিই পৃথিবীর অভিধান থেকে মুছে যাবে ‘আত্মহত্যা’ শব্দটি। অবসাদের অন্ধকার ভেদ করে জন্ম নেবে নতুন জীবনের দীপ্তিময় গান।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবার আরেকটি চ্যালেঞ্জ তহবিল। পুরো বিশ্বের স্বাস্থ্য বাজেটের এক শতাংশেরও কম খরচ হয় মানসিক স্বাস্থ্য খাতে। বাংলাদেশে তো অবস্থা আরও খারাপ। এই খাতে অর্থায়ন বাড়ানো জরুরি। হাসপাতাল, কাউন্সেলিং সেন্টার, হেল্পলাইন সবকিছুতেই দরকার বিনিয়োগ। মানসিক ব্যাধি চিকিৎসায় প্রয়োজন বহুমাত্রিক সেবা। মনোবিজ্ঞানী, সমাজকর্মী, থেরাপিস্ট, পরামর্শদাতা সবাইকে নিয়ে একটি দল তৈরি করতে হবে। আর রোগীকে সমাজের অংশ হিসেবেই রাখতে হবে। নিপীড়ন, অবহেলা, কলঙ্ক এই সংস্কৃতি ভাঙতে হবে। বাংলাদেশের মত ইসলাম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে আত্মহত্যা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও আলোচিত বিষয়। ইসলাম আত্মহত্যাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু ধর্মের নাম নিয়ে পরিবার এই সমস্যা আড়াল করে। অথচ ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে মানুষকে বোঝানো যায় জীবন আল্লাহর অমূল্য দান। তাই জীবন রক্ষা করা ঈমানের অংশ। সঠিক ধর্মীয় ব্যাখ্যা মানুষকে মৃত্যুর পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে। অবশেষে প্রশ্ন আসে সমাধান কী? সমাধান একক নয়। সমাধান বহুমাত্রিক। প্রতিটি পরিবার হতে হবে সহানুভূতিশীল পরিবার। প্রতিটি বিদ্যালয় হতে হবে শিক্ষামূলক। প্রতিটি সমাজ হতে হবে সহমর্মী। রাষ্ট্রকে হতে হবে দায়িত্বশীল। আর গণমাধ্যম হতে হবে ইতিবাচক। পৃথিবীর সব ভাষা থেকে ‘আত্মহত্যা’ শব্দটি মুছে যাক। মানুষ তার দুঃখের ভেতরেও খুঁজে পাক আশার আলো। অবসাদ থেকে জন্ম নিক নবজীবনের গান।
শিক্ষক
কাদিরাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল, নাটোর।

Discussion about this post