রেজাউল করিম খোকন : ৫ আগস্ট সারাদেশে উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে জুলাই অভ্যুত্থানের বার্ষিকী উদযাপিত হয়েছে। এদিন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ঘোষণা দিয়েছেন এবং জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেছেন। এসব নিশ্চয়ই আনন্দের খবর। কিন্তু যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে এক বছর আগে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল, সেটা কতটা পূরণ হলো, সেই আত্মজিজ্ঞাসাও জরুরি। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো বিনির্মাণের কাজটি সহজ নয়। কোথাও সামান্য ব্যত্যয় হলে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের যে অঙ্গীকার অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা করেছে, সেটি বাধাগ্রস্ত এবং এমনকি নস্যাৎ হয়েও যেতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন নিয়ে। ফলে তাদের সহযোগিতা না পেলে সরকারের পক্ষে কোনো উদ্যোগই সফল করা সম্ভব নয়। সংস্কারের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিলে সরকার বা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষে সিদ্ধান্তে আসা কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলের সংস্কার। যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন, তাদের মধ্যেও গণতান্ত্রিক মানসিকতা থাকতে হবে। কর্তৃত্ববাদী শাসনামলে চাঁদাবাজি, দখলবাজির যে মহড়া চলছিল, তাদের বিদায় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা বন্ধ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কঠিন বাস্তবতা হলো, বন্ধ হয়নি। কুশীলব বদল হয়েছে মাত্র। আগে এক দলের নেতাকর্মীরা চাঁদাবাজি ও দখলবাজিতে লিপ্ত ছিলেন, এখন অনেক দলের নেতাকর্মীরা সেই কাজ করছেন। এ অবস্থায় সংস্কার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা অসম্ভব।
২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এমন এক সময়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, যখন চারদিকে ছিল চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা—প্রশাসন অচল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিষ্ক্রিয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অরাজকতা, জনজীবনে অনিশ্চয়তা। ৫ আগস্ট যেদিন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে, সেদিন মুহাম্মদ ইউনূস ছিলেন প্যারিসের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবেন। ওই দিন সন্ধ্যায় আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতাদের পক্ষ থেকে প্রথম তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ছাত্রনেতাদের বারবার অনুরোধে তিনি সরকারের দায়িত্ব নিতে রাজি হন। ছাত্রনেতাদের সেদিনকার চিন্তা সঠিকই ছিল। সেই অনিশ্চিত সময়ে এমন একজন ব্যক্তির প্রয়োজন ছিল, যার প্রতি দেশের বৃহত্তর জনগণের আস্থা আছে এবং আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। আন্দোলনে যেসব রাজনৈতিক দলের সক্রিয় ভূমিকা ছিল, তারাও অধ্যাপক ইউনূস ছাড়া অন্য কারও নেতৃত্ব মেনে নিত কি না সন্দেহ। অতএব, পর অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা বিচার করতে হবে আমাদের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে। অতীতে আমাদের নির্বাচিত কিংবা অনির্বাচিত সরকারগুলো কী করেছে, তাও মনে রাখতে হবে। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের প্রধান আকাঙ্ক্ষা ছিল স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন। কিন্তু এটি রাস্তায় নেমে আসা লাখ লাখ ছাত্র-জনতার একমাত্র প্রত্যাশা ছিল না। গণ-অভ্যুত্থানের কোনো লিখিত ইশতেহার না থাকলেও মিছিলে, স্লোগানে, বক্তৃতায়, দেয়াল লিখনে প্রত্যাশাগুলো ফুটে উঠেছিল। এ রকম কতগুলো দেয়াল লিখন ও স্লোগান হলো, ‘বৈষম্যহীন বাংলাদেশ’, ‘সংস্কার চলছে’, ‘আমরাই গড়ব বৈষম্যহীন সরকার’, ‘মেয়ে-ছেলে বৈষম্য নয়, মানুষ হিসেবে সবার পরিচয়’, ‘ধর্মবৈষম্য নিপাত যাক’, ‘সমতল থেকে পাহাড়, এবারের মুক্তি সবার’, ‘চা-শ্রমিকের বেতন বাড়াও’, ‘একজন রিকশাচালকের সন্তানও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখে’, ‘এলিটদের রাষ্ট্রব্যবস্থা না, গণমানুষের রাষ্ট্রব্যবস্থা’, ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’ ইত্যাদি। এসব দেয়াল লিখনের মধ্য দিয়ে জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, শ্রেণি ইত্যাদি সব ধরনের বৈষম্য থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়ে উঠেছিল। শুধু ব্যক্তি নয়, গোটা ব্যবস্থা পরিবর্তনের দাবি উঠেছিল। গণ-অভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় কতটা পূরণ হলো সেসব প্রত্যাশা?
বাংলাদেশ হলো বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, ৫৬ হাজার বর্গমাইলে প্রায় ১৮ কোটি মানুষের বাসের দ্বিতীয় উদাহরণ নেই। এখানে দারিদ্র্যের হার ১৮ শতাংশ, শিক্ষার সুযোগ থেকে এখনও ৩০ শতাংশ মানুষ বঞ্চিত, ভূমিহীন ও গৃহহীনদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, বাড়ছে ধনী-গরিবের বৈষম্যও। নির্বাচিত সরকার পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় আসে। তাদের পক্ষে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়া সহজ। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে তা নেয়া সম্ভব নয়। তদুপরি ইউনূস সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখন দেশে আইনশৃঙ্খলা বলতে কিছু ছিল না। এ অবস্থায় সরকারের প্রধান ও প্রথম কর্তব্য হয়ে পড়েছিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা। দ্বিতীয় কর্তব্য হয় বিশৃঙ্খল অর্থনীতিকে শৃঙ্খলায় নিয়ে আসার পাশাপাশি বাজার নিয়ন্ত্রণ। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সরকার কিছুটা হলেও সফল হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে ধ্বংসের কিনারে যাওয়া ব্যাংকিং খাতকে শৃঙ্খলায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। মুহাম্মদ ইউনূস যাদের নিয়ে সরকার গঠন করেন, তাদের বেশির ভাগই ছিলেন রাজনীতি ও প্রশাসনের বাইরের মানুষ। স্বাভাবিকভাবে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় তাদের পদে পদে হোঁচট খেতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। বয়স, অভিজ্ঞতার কারণেও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের সবার কাজের দক্ষতা একই রকম নয়। কয়েকজন নিজের মন্ত্রণালয় চালানোর বিষয়ে সক্রিয়তা দেখালেও অন্যদের এ বিষয়ে বেশ ঘাটতি আছে বলে অনেকে মনে করেন। মুহাম্মদ ইউনূস স্বীকার করেছেন, দেশ পরিচালনার কোনো অভিজ্ঞতা তার বা তার সরকারের বেশির ভাগ উপদেষ্টার নেই। কোনো মন্ত্রণালয়ে ভালো কাজ হলে তার কৃতিত্ব সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা নিতে পারেন, নিচ্ছেনও। কিন্তু কোনো মন্ত্রণালয় কাঙ্ক্ষিত ফল দেখাতে না পারলে সেই দায় পুরো সরকার, আরও নির্দিষ্ট করে বললে প্রধান উপদেষ্টার ওপরই পড়ে। বিভিন্ন মহলে সমালোচনা আছে, অন্তর্বর্তী সরকার ঠিকমতো দেশ চালাতে পারছে না। এই সমালোচনা ভিত্তিহীন নয়। কোনো কোনো উপদেষ্টার নিষ্ক্রিয়তা পীড়াদায়কও। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা পদে মুহাম্মদ ইউনূসের বিকল্প কারও কথা ভাবা যেত কি? অন্য কেউ কি বিবদমান পক্ষগুলোকে এক টেবিলে বসাতে পারতেন?
অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দল ও পক্ষকে এক টেবিলে বসানো। সেই কাজে তারা মোটামুটি সফল হয়েছেন। বিলম্বে হলেও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছে। বাংলাদেশে এর আগে যতগুলো রাজনৈতিক পরিবর্তন এসেছে, তার পেছনে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা ছিল। পার্থক্য হলো, ৫ আগস্টের পরিবর্তনে সেনাবাহিনীর ইতিবাচক ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও তারা বেসামরিক প্রশাসনে নাক গলায়নি। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বারবার বলেছেন, ক্ষমতায় আসার কোনো ইচ্ছা তাদের নেই। বেসামরিক সরকার যে সেনাবাহিনীর অব্যাহত সহযোগিতা পেয়ে আসছে, সেটাও মুহাম্মদ ইউনূস ছাড়া সম্ভব হতো কি না সন্দেহ আছে। এরপরও সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে নানা রকম প্রচারণা ও উসকানি দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। কেউ কেউ অন্তর্বর্তী সরকার ও সেনাবাহিনীকে মুখোমুখি অবস্থানে নিয়ে আসারও চেষ্টা চালাচ্ছেন। এসব দেশকে আরও অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক মহলেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। গত বছর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যোগদানকালে অধ্যাপক ইউনূস তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ ১২টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এর বাইরে ৪০টি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেন তিনি। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বাংলাদেশ সফর প্রায় দৃষ্টির পেছনে যাওয়া রোহিঙ্গা সমস্যাকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে আশা করা যায়। দায়িত্ব নেয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারকে বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এর একটি হলো পূর্বাঞ্চলের ওপর দিয়ে বন্যার তাণ্ডবে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি। কয়েক মাস ধরে বাজার অস্থিতিশীল থাকার পর এখন কিছুটা নিম্নগামী। রোজায় নিত্যপণ্যের দাম অনেকটা নিয়ন্ত্রণেই আছে। যেমনটি বিগত বছরগুলোয় দেখা যায়নি। খাদ্যের মজুতও সন্তোষজনক। সরকারের এসব সাফল্য সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি জনমনে উদ্বেগ তৈরি করেছে। ডাকাতি, ছিনতাই, খুন-ধর্ষণের ঘটনা তো আছেই। ৫ আগস্টের পর নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছে—মব ভায়োলেন্স বা সহিংসতা। আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপি-জামায়াত শিবির ট্যাগ লাগিয়ে নিরীহ মানুষের ওপর নির্যাতন চালানো হতো। অভ্যুত্থানের পর ছাত্র-জনতার আক্রোশে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক মন্ত্রী-এমপি-নেতার ঘরবাড়ি হামলা ও ভাঙচুরের শিকার হয়। আবার স্বৈরাচারের দোসর ট্যাগ দিয়ে অনেক নিরীহ মানুষের বাড়িঘর, অফিস, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও হামলা চালানো হয়, কিছু জায়গায় আক্রান্ত হয়েছেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও। কেউ অপরাধ করলে তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হলো আইনানুগ নাগরিকের দায়িত্ব। সেটা না করে ছাত্রনেতৃত্ব বা অন্য কারও নামে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া হলে সমাজে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে সাহসী ভূমিকা না নিতে পারা ব্যর্থতা বলেই মনে করি।
অন্তর্বর্তী সরকার মোটাদাগে তিনটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। জুলাই অভ্যুত্থানের সময়কার হত্যা-নির্যাতনের বিচার, স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনরাগমন ঠেকাতে রাষ্ট্রীয় সংস্কার ও গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান। কিন্তু তারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে না পারলে, মব ভায়োলেন্স চলতে থাকলে কোনো লক্ষ্যই অর্জন করা যাবে বলে মনে হয় না। প্রত্যেক নাগরিকের জানমালের সুরক্ষায় সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের দুটি ইতিবাচক দিক উল্লেখ করা প্রয়োজন। একটি হলো, টিমওয়ার্ক বা সমন্বিত কার্যক্রম। অতীতের প্রায় সব সরকারই ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক সরকারপ্রধান না বললে কিছু হতো না। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা স্বাধীনভাবেই মন্ত্রণালয় পরিচালনা করছেন। দ্বিতীয়ত, এই সরকারের উপদেষ্টাদের দক্ষতা নিয়ে যত সমালোচনাই থাকুক, এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগ আসেনি। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক কাঠামোয় এটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ‘জুলাই বিপ্লব ২০২৪’ দেশ, সমাজ ও রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। অবশ্য এ বিপ্লবের চেতনা এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষা এখনও পূর্ণতা পায়নি। ঐক্যের মাধ্যমে অর্জিত যা কিছু ছিল, তা এখন দুর্বল ও ভঙ্গুর মনে হচ্ছে এবং এর ফলে বাংলাদেশের মানুষের মনে গভীর উদ্বেগ ও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে নির্বাচন কমিশনকে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে বলেন, আমরা এমন একটি নির্বাচন করতে চাই, যা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। উল্লেখ্য, গত তিনটি প্রহসনমূলক নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেননি; বিশেষ করে ২০০৮ সালের পর যারা নতুন ভোটার হয়েছেন, তারা এই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের নির্বাচনটি হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক, যাতে প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীসহ সবাই ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। এর আগে লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, সংস্কার ও বিচার দৃশ্যমান হলে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে। এবার প্রধান উপদেষ্টা স্পষ্ট করেই বলেছেন, রোজার আগে নির্বাচন হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে যে জুলাই সনদ সই হওয়ার কথা, সেটাও প্রায় চূড়ান্ত বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তবে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছাই যথেষ্ট নয়; রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় সহযোগিতাও আবশ্যক। জুলাই ঘোষণাপত্রে যেসব অঙ্গীকার ও প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে, তা বাস্তবায়ন তথা ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণে দলমত-নির্বিশেষে সবাই একযোগে কাজ করবে, এটাই প্রত্যাশিত। কর্তৃত্ববাদী সরকার বিদায় নেয়ার পর আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হয়নি, সে কথা আমরা বলছি না। তবে যে মাত্রায় পরিবর্তন হওয়ার কথা ছিল, সেটা হয়নি। বিষয়টি অনেকটা গ্লাসের অর্ধেক পূর্ণ ও অর্ধেক খালি থাকার মতো। এক বছরের সাফল্য-ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের আগে যেটুকু সময় পাওয়া যাচ্ছে, গণতান্ত্রিক রূপান্তর ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা নেবে বলে আশা করি। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের বার্ষিকীতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি ঘোষণা এসেছে—যার একটি হলো আগামী বছর রোজার আগে ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান, অপরটি জুলাই ঘোষণাপত্র।
নির্বাচনের তারিখ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে যে বিতর্ক ও জনমনে সংশয় ছিল, জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণের পর তার অবসান হয়েছে আশা করি। এই ভাষণে তিনি বর্তমান সরকারের আমলে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নেয়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের কথা জানিয়েছেন। কীভাবে স্বৈরাচারী সরকারের রেখে যাওয়া প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতিকে সচল করেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন করেছেন—এরও বিবরণ দিয়েছেন তিনি। একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন এবং রাষ্ট্রকাঠামোর গণতান্ত্রিক রূপান্তরে তার সরকার, বিশেষ করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে কঠোর পরিশ্রম করেছে, সে কথাও উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতার কথাও তিনি স্মরণ করেছেন। ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সরকারই রাষ্ট্র পরিচালনা করবে; সে ক্ষেত্রে দলগুলোর মতৈক্য ও বোঝাপড়া খুব জরুরি। প্রধান উপদেষ্টা জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেছেন, যাতে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের সাংবিধানিক স্বীকৃতির কথা আছে। ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র দেয়ার দাবি উঠেছিল অনেক আগেই। এই প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করে; যার প্রতিফলন আমরা গণ-অভ্যুত্থানের বার্ষিকীতে প্রত্যক্ষ করলাম। জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন ছিল। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ দাবি করে আসছিল। কোনো কোনো দল জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন দাবি করে আসছিল। মৌলিক সংস্কার ও বিচারের পরই হবে নির্বাচন—এমন কথাও বলা হচ্ছিল। নির্বাচনপদ্ধতি নিয়েও ভিন্নমত ছিল। এসব কারণে রাজনীতি বিশ্লেষকদের কণ্ঠেও ছিল অবিশ্বাস, অনিশ্চয়তা। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দেন, তাতে সেই অনিশ্চয়তার অনেকটাই অবসান হয়েছে। তিনি বলেছেন, নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হবে ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগে। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণাকে তাৎক্ষণিকভাবে স্বাগত জানিয়েছে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো। আমরা মনে করি, এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আরও বেশি প্রতিষ্ঠিত হবে এবং এখন আর কোনো রকমের অনিশ্চিত পরিবেশ থাকবে না। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণা এক ধাপ অগ্রগতি। অনির্বাচিত সরকার যত দিন ক্ষমতায় থাকবে, সংকট ততই বাড়বে। আমরা আশা করি, দ্রুতই নির্বাচন কমিশন সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঘোষণা করবে। ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। এদিকে বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যৎ এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখার প্রত্যাশা জানিয়েছে ঢাকায় অন্তত ছয়টি পশ্চিমা দূতাবাস। গণ-অভ্যুত্থানের প্রধান প্রত্যাশা পূরণের পথে যে অগ্রগতি সূচিত হয়েছে, আমরা তাকে স্বাগত জানাই। আমরা আশা করি, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চর্চা ও নির্বাচনের ইতিহাসে আগামী নির্বাচন হবে একটি অনন্য মাইলফলক।
অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক

Discussion about this post