রেজাউল করিম সিদ্দিকী : নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য ট্রেন বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। যাত্রীসাধারণের চাহিদার তালিকায় রেলওয়ে এক নম্বরে রয়েছে। এদেশেও রেলভ্রমণ যাত্রীদের কাছে সর্বাধিক জনপ্রিয়। সড়কে যানজট, নৌপথে সময়ের অপচয়, কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে নৌপথের অভাব এবং আকাশপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে অতিরিক্ত খরচ হয়। অন্যদিকে দেশের ৪৮ জেলায় বিস্তৃত রেল নেটওয়ার্ক, দ্রুত সময়ে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন, সর্বোপরি সবচেয়ে কম খরচের কারণে ট্রেন দেশের যাত্রীদের চাহিদার এক নম্বর গণপরিবহন। বর্তমান বাংলাদেশ অধ্যুষিত ভূখণ্ডে ট্রেন যোগাযোগ চালু হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনামলে। চালুর পর থেকে অদ্যাবধি এর জনপ্রিয়তা ও চাহিদা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে রেললাইনের বিস্তৃতি এবং যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের সক্ষমতা। বর্তমানে সারাদেশে সচল রেলরুটের দৈর্ঘ্য তিন হাজার ৪৯৩ দশমিক ৫৪ কিলোমিটার। এছাড়া আরও ৬১ দশমিক ৬০ কিলোমিটার মিটারগেজ রেললাইন অব্যবহূত অবস্থায় রয়েছে। দেশে ১৫৬টি মিটারগেজ ও ১৩২টি ব্রডগেজ, মোট ২৮৮টি লোকোমোটিভ রয়েছে। অপরদিকে ক্যারেজ রয়েছে ১ হাজার ৮৩৮টি, এর মধ্যে মিটারগেজ ১ হাজার ২৬৭টি ও ব্রডগেজ ৫৭১টি। এছাড়া পণ্যবাহী ওয়াগন রয়েছে ৩ হাজার ৭৪১টি তার মধ্যে ওয়াগন ৩ হাজার ৬১৬টি, লাগেজ ভ্যান ১২৫টি। আন্তঃনগর, মেইল, কমিউটার ও লোকাল—সব মিলিয়ে প্রতিদিন রেলপথে যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা প্রায় দুই লাখ। সংখ্যা ও বিস্তৃতি বিবেচনায় রেলপথ সড়ক থেকে পিছিয়ে থাকলেও জনপ্রিয়তায় রেল এক নম্বরে রয়েছে।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে রেলপথে যাত্রীদের চাহিদার বিপরীতে রেলের সক্ষমতা বেড়েছে নগণ্যই। তাছাড়া রেল নিয়ে রয়েছে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ। চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল আসন, টিকিট কালোবাজারি, ক্রয় কার্যক্রমে অনিয়ম, আর্থিক শৃঙ্খলার অভাব, নিয়োগ ও পদোন্নতিতে দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি প্রভৃতি অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এসব অভিযোগের যে সত্যতা নেই তাও নয়। দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম ও দুর্নীতি সরকারের বেশিরভাগ দপ্তরেই রয়েছে। রেলওয়েও এর ব্যতিক্রম নয়। অভিযোগ সত্ত্বেও ক্রমান্বয়ে রেলের সেবার মান এবং যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে সক্ষমতা বেড়েছে তাতে সন্দেহ নেই। তবে এই সক্ষমতা বিদ্যমান বাজেটের মধ্যেও কয়েকগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব ছিল বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। ক্রয় কার্যক্রমে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, পর্যাপ্ত নজরদারি ও স্বচ্ছতার অভাব, রাজনৈতিক বিবেচনায় বিভিন্ন স্থানে স্টেশন নির্মাণ এবং অপ্রয়োজনীয় রুটে ট্রেন পরিচালনার ফলে রেলওয়ের লোকসানের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বেড়েছে। গত কয়েক বছরে গড়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রায় আড়াই টাকা ব্যয়ে এক টাকা আয় করতে সক্ষম হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর গড়ে এর মোট বাজেটের প্রায় ৬০ শতাংশ লোকসান গুনতে হচ্ছে। এর নানা ধরনের কারণ রয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের লোকসান কমিয়ে আনতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। লোকসান কমাতে রেলওয়ে আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যয় সংকোচনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য বেশকিছু বড় প্রকল্পের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কাটছাঁট করে ব্যয় হ্রাস করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে যথাযথ পরিকল্পনার কারণে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ (২য় সংশোধিত) প্রকল্পে ৬২১ দশমিক ৮৯ কোটি টাকা; দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুনধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ (২য় সংশোধিত) প্রকল্পে ৬ হাজার ৬৯৮ দশমিক ৫০৪৯ কোটি টাকা; আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ এবং বিদ্যমান রেললাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর (২য় সংশোধিত) প্রকল্পে ৮৫৯ দশমিক ২ কোটি টাকা; বাংলাদেশ রেলওয়ের রোলিং স্টক অপারেশন উন্নয়ন (রোলিং স্টক সংগ্রহ) (১ম সংশোধিত) প্রকল্পে ৩৯ দশমিক ১২৯৭ কোটি টাকা; আখাউড়া-আগড়তলা ডুয়েলগেজ রেল সংযোগ নির্মাণ (বাংলাদেশ অংশ) প্রকল্পে ১৯১ দশমিক ৮৩১৮ কোটি টাকা; খুলনা থেকে মংলা পোর্ট পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ (তৃতীয় সংশোধিত) প্রকল্পে ১৮৩ দশমিক ৩ কোটি টাকা, মোট ৮ হাজার ৫৯৩ কোটি ৮৫ লক্ষ ৭৯ হাজার টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া রেলওয়ের অপারেশন ব্যয় হ্রাস করা হয়েছে। সেইসঙ্গে আয় বৃদ্ধির জন্য রেলওয়ের রুট রেশনালাইজেশনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ের মালিকানাধীন বিপুল পরিমাণ ভূসম্পত্তি অব্যবহূত রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে জমি অধিগ্রহণের ফলে রেলওয়ের মালিকানাধীন ভূসম্পত্তির পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব ভূসম্পত্তির বিশাল অংশ স্থানীয় জনগণের অবৈধ দখলে রয়েছে, যা থেকে সম্ভাব্য রেভিনিউ আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। অবৈধ দখলে থাকা এসব ভূমি উদ্ধার এবং তা নিয়মতান্ত্রিকভাবে ইজারা প্রদানের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় সম্ভব। এই সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ে ভূসম্পত্তি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা হালনাগাদ করা হচ্ছে। একইসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের অপটিক্যাল ফাইবার লিজ প্রদানের নীতিমালাও হালনাগাদ করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, সারাদেশে বিস্তৃত রেললাইনের সঙ্গে রেলওয়ের নিজস্ব যোগাযোগ ও সিগন্যাল ব্যবস্থাপনার জন্য রয়েছে রেলওয়ের নিজস্ব অপটিক্যাল ফাইবার লাইন। এই লাইন রেলওয়ের নিজস্ব ব্যবহারের পাশাপাশি মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিকে ইজারা প্রদানের মাধ্যমে রেলওয়ে প্রচুর পরিমাণ রাজস্ব আয় করে থাকে। রেলওয়ের ভূসম্পত্তি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ও অপটিক্যাল ফাইবার লিজ প্রদান নীতিমালা হালনাগাদ করা হলে রাজস্ব আয়ের পরিমাণ কয়েকগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।
রেলওয়েকে আর্থিকভাবে টেকসই করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে অপারেটিং রেশিও (ব্যয় ও আয়ের অনুপাত) ২ দশমিক ৫০ থেকে ২ দশমিক ০৯-এ হ্রাস পেয়েছে। এই অনুপাত ২-তে নামিয়ে আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ঢাকা-জয়দেবপুর-ঢাকা রুটে এক জোড়া, ঢাকা-নরসিংদী-ভৈরববাজার-নরসিংদী-ঢাকা রুটে এক জোড়া এবং ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে নতুন আঙ্গিকে আট জোড়া কমিউটার ট্রেন চালু করা হয়েছে। গত দুই দশকে বিশেষ করে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে পৃথক করে রেলপথ মন্ত্রণালয় গঠনের পর নতুন করে বেশ কয়েকটি রুটে রেল ট্র্যাক নির্মাণ করা হয়েছে। কয়েকটি রুটে নতুন ট্রেন পরিচালনা করা হচ্ছে। এসব রুটে যাত্রীও হচ্ছে পর্যাপ্ত। কিন্তু প্রয়োজনীয়সংখ্যক কোচ ও লোকোমোটিভ না থাকায় চাহিদা ও সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও রেলওয়ে পর্যাপ্ত ট্রেন পরিচালনা করতে পারছে না। ফলে চাহিদার তুলনায় স্বল্পসংখ্যক যাত্রী পরিবহন করতে পারছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। অবস্থা উত্তরণের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রয়োজনীয় কোচ ও লোকোমোটিভ আমদানির উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। লোকোমোটিভ আমদানির জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে এরই মধ্যে খসড়া স্পেসিফিকেশন প্রস্তুত করেছে। সেইসঙ্গে পুরোনো কোচ ও লোকোমোটিভ প্রয়োজনীয় মেরামত ও মেইন্টেন্যান্সের মাধ্যমে সচল করার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানার (কেলোকা) সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
গত এক বছরে ১৭৭টি অভিযানের মাধ্যমে ৫ হাজার ৮১৫টি অবকাঠামো উচ্ছেদ করে অবৈধ দখলে থাকা মোট ৯৯ দশমিক ০৯২ একর ভূমি উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় বাংলাদেশ রেলওয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে ২০৫ জন ওয়েম্যান, ৮০ জন বুকিং সহকারী ও ২৭ জন টিকিট কালেক্টর নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া পৃথক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ৫৬৮ জন পয়েন্টসম্যান, ৩৫৩ সহকারী লোকো মাস্টার (গ্রেড-২), ১২ জন আমিন ও ৫ জন ফিল্ড কানুনগো নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে।
রেলওয়ে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে প্রতিষ্ঠানটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান। আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া রেলের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু লোকসান হ্রাস করে কাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিতরণে রেলওয়ের নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বিগত সময়ে বিভিন্ন সরকার বিভিন্নভাবে রেলওয়েকে ব্যবহার করেছে। রেল উন্নয়নে কাজও হয়েছে বিভিন্ন আঙ্গিকে। এর মধ্যে বেশকিছু উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে, সফলতার তালিকাও লম্বা। সবকিছু ছাপিয়ে রেলের সেবার মান ও সক্ষমতা বেড়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে রেলকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তন করতে হলে যাত্রী পরিবহনের সঙ্গে পণ্য পরিবহন বৃদ্ধি করতে হবে। শুধু যাত্রী পরিবহনের মাধ্যমে কোনো দেশেই রেল লাভজনক হয় না; হবেও না। যেসব দেশের রেল লাভজনক, বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সেসব দেশে মোট পণ্য পরিবহনের ৩০-৩৫ শতাংশ রেলপথে পরিবহন করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে মোট পণ্যের মাত্র দুই শতাংশেরও কম পণ্য রেলপথে পরিবহন করা হয়। সারাদেশে সড়ক ও নৌপথে যে পরিমাণ পণ্য পরিবহন হয় তার ২০-২৫ শতাংশ পণ্য যদি রেলপথে পরিবহন করা যায়, তাহলে বাংলাদেশ রেলওয়ে তার লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। রেলপথে পণ্য পরিবহণ বৃদ্ধি করতে না পারলে শত প্রচেষ্টায় রেলের লোকসান সামান্য হ্রাস করা সম্ভব হলেও কোনোক্রমেই একে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা সম্ভব নয়। রেলকে লাভজনক করতে হলে রেলপথে পণ্য পরিবহন বৃদ্ধি করতে হবে। রেলস্টেশনকেন্দ্রিক বাণিজ্য ও বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। রেলপথে পণ্য পরিবহনের জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রয়োজনীয় প্রচারণা ও ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে রেলপথে পণ্য পরিবহনের সুবিধাগুলো মানুষকে অবহিত করতে হবে।
সম্প্রতি কোরবানির পশু পরিবহনের জন্য ক্যাটেল স্পেশাল, আম পরিবহনের জন্য ম্যাংগো স্পেশাল এবং কৃষিপণ্য ও সবজি পরিবহনের জন্য যে বিশেষ ট্রেন পরিচালনা করা হয়েছে, যা পর্যাপ্ত সমীক্ষা ও বাজার যাচাইয়ের মাধ্যমে করা হয়নি। ফলে এসব ট্রেনের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পণ্য পরিবহন সম্ভব হয়নি। ফলে এসব সার্ভিসের মাধ্যমে একদিকে যেমন রেলওয়ে লাভবান হয়নি, অন্যদিকে এতে রেলওয়ের রেপুটেশন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মারাত্মকভাবে। প্রয়োজনীয় সমীক্ষা ও বাজার যাচাইয়ের মাধ্যমে পণ্য পরিবহণের উদ্যোগ গ্রহণ করলে এবং সাধারণ মানুষ এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলে রেলপথে পণ্য পরিবহণ অবশ্যই বাড়বে এবং রেলের আয় বৃদ্ধি ও লোকসান হ্রাস পেয়ে একসময় লাভজনক প্রতিষ্ঠাকালে পরিণত হবে।
পিআইডি নিবন্ধ

Discussion about this post