শেয়ার বিজ ডেস্ক : জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যকার সম্পর্ক ক্রমেই শীতল হয়ে উঠছে। বিশেষ করে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহর সাম্প্রতিক বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা ও সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের লাগামহীন বক্তৃতা কেবল রাজনৈতিক দূরত্বই নয়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আস্থাহীনতাও প্রকাশ করছে। কেউ কেউ মনে করছেন, এটি একটি কৌশলী অবস্থান, যার উদ্দেশ্য হতে পারে জনসমর্থন রক্ষা করা বা বৃহত্তর ক্ষমতার কাঠামোয় অবস্থান শক্ত করা।
গত মঙ্গলবার চাঁদপুর শহরের বাসস্ট্যান্ডে অনুষ্ঠিত এনসিপির পথসভায় হাসনাত বলেন, ‘এই সরকারের কাছে অনেক প্রত্যাশা ছিল। অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর ইচ্ছা ছিল। কিন্তু স্বাস্থ্যব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা এখনো আগের মতোই। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের সমালোচনা করে তার পদত্যাগ চেয়েছেন হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, তার একমাত্র যোগ্যতা হলো গ্রামীণ ব্যাংকে কাজ করা এবং ইউনূস সাহেবের ঘনিষ্ঠ হওয়া। এমন একজন মানুষ আমাদের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা! তিনি নিজে চিকিৎসা করাতে সিঙ্গাপুর যান, এটা সাধারণ মানুষের সঙ্গে কেমন তামাশা?’
এ বক্তব্য ঘিরে এনসিপির ভেতরে ও বাইরে নানা মতভেদ দেখা দিয়েছে। কিছু নেতার মতে, এই বক্তব্য দলীয় নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের অংশীদার হিসেবে দায়িত্বশীল আচরণ আশা করি। কিন্তু কিছু নেতা অহেতুক উত্তেজক ভাষা ব্যবহার করে দলকে বিব্রত করছেন। হাসনাত সাহেবের বক্তব্য আমাদের পলিসির প্রতিনিধিত্ব করে না।’
তবে দক্ষিণাঞ্চলের নেতারে অনেকে এসব বক্তব্যকে সঠিক বলে আখ্যা দিচ্ছেন। বরিশালের এনসিপি নেতা মো. সামসুল ইসলাম বলেন, ‘স্বাস্থ্য উপদেষ্টার বিষয়ে আমাদের সমন্বয়কের বক্তব্য ঠিকই আছে। অনেক আগে থেকেই আমরা লক্ষ করছি, ইউনূস ঘনিষ্ঠরে অযোগ্যভাবে পে বসানো হচ্ছে। এটা এখনই বন্ধ না করলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
সাবেক ছাত্রনেতা আশিক রহমান বলেন, ‘এটা পরিষ্কার যে এনসিপি নিজেদের আলাদা অবস্থান প্রমাণ করতে চাইছে। তারা এখন ‘অবস্থান নিচ্ছে’, যেন ভবিষ্যতে সরকারের ব্যর্থতা থেকে নিজেদের আলাদা রাখতে পারে। এটা রাজনৈতিক কৌশল, একধরনের ‘আইওয়াশ’ও বলা যেতে পারে।’
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক লের (জাস) নেতা নারায়ণ পাল বলেন, ‘যদি সত্যিই এনসিপি সরকারে আস্থা না রাখে, তাহলে স্পষ্টভাবে জোট ত্যাগ করা উচিত। মুখে সমালোচনা করে সরকারে থাকা রাজনৈতিক দায়িত্ব এড়ানোর নামান্তর।’
তবে ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তী সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, ‘নাগরিক পার্টি একটি উদীয়মান রাজনৈতিক শক্তি। তবে তাদের কিছু নেতা অপ্রয়োজনীয় ও অসম্মানজনক মন্তব্য করছেন। সরকার সব ধরনের গঠনমূলক সমালোচনা স্বাগত জানায়, কিন্তু ব্যক্তিগত আক্রমণ কখনোই কাম্য নয়।
হাসনাত আবদুল্লাহ এদিন আরও বলেন, ‘ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করছেন। স্বাস্থ্য উপষ্টো নূরজাহান বেগম তার ছায়া। তাকে নিয়ে আমরা কী করব? তিনি যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন। জনগণের করের টাকায় তার থাকা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।
রাজনীতিবিদদের মতে, ড. ইউনূসের প্রতি এমন আক্রমণ শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তৈরির চেষ্টা। ইউনূস সরকার আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত এবং তার ছায়ায় থাকা উপদেষ্টাদের আক্রমণ করে এনসিপি জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা করছে বলেও মত বিশ্লেষকদের।
সুশীল সমাজের কেউ কেউ বলছেন, এনসিপির এই অবস্থান আসলে বিকল্প রাজনৈতিক বলয় গঠনের ইঙ্গিত। তারা মনে করছেন, এনসিপি নিজস্ব পরিচিতি তৈরি করতে চায় এবং এজন্য তারা সরকারের ব্যর্থতাকে কৌশলে তুলে ধরছে। তবে এটি বেশি দিন টিকবে না যদি দলীয় ঐক্য না থাকে।
এনসিপির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড প্রমাণ করছে, লটি অভ্যন্তরীণভাবে মতবিভাজনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখতে চায়, আবার কেউ কেউ কঠোর বিরোধিতার মাধ্যমে জনমনে জায়গা করে নিতে চায়।
অন্তর্বর্তী সরকার ও এনসিপির মধ্যকার সম্পর্ক এখন স্পষ্টতই এক ধরনের টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে। হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্য এ সম্পর্ককে আরও ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। এটি ভবিষ্যতের জন্য কী ইঙ্গিত বহন করে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে এতটুকু স্পষ্টÑএনসিপি এখন নিজেদের অবস্থান নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে চাইছে। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কি সত্যিই বিকল্প শক্তি হতে পারবে, নাকি কৌশলী আইওয়াশেই থেমে যাবে?

Discussion about this post