জোবায়েদা ইসলাম : বিশ্ববিদ্যালয় নাকি ভবিষ্যৎ প্রজš§ তৈরির কারখানা। কিন্তু সেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ যদি পরিণত হয় রণক্ষেত্রে; প্রাণের উচ্ছ্বাসের পরিবর্তে যদি ভেসে আসে আতঙ্ক, রক্ত ও বারুদের গন্ধ, তাহলে প্রশ্ন ওঠেÑ আমরা কি সত্যিই শিক্ষাকে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ স্থানে রূপান্তর করতে পেরেছি নাকি এটি হয়ে উঠেছে ভয়, অরাজকতা ও রাজনৈতিক প্রভাবের আবরণে আবদ্ধ এক বিভীষিকাময় ক্ষেত্র?
ফেসবুক চালাতে চালাতে হঠাৎ চোখের সামনে আসল কিছু বীভৎস দৃশ্য। এই দৃশ্যে কেউ লাঠি, কেউ দা, কেউ ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিশংসভাবে একজনের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। একটু পরেই পাশের রুম থেকে টেলিভিশনে ভেসে আসছে যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছে স্থানীয়রা। দৌড়ে গিয়ে দেখি ফেসবুকে দেখা ভিডিওগুলো আর খবরে দেখা ভিডিওগুলো একই। বুঝতে বাকি রইল না চবি শিক্ষার্থীদের ওপর নেমেছে অমানুষিক নির্যাতন। একজন শিক্ষার্থীর হাতে কলম থাকার কথা এবং সে কলম দিয়ে দেশ বিনির্মাণ করার কথা। অস্ত্র হাতে তুলে নেয়া কোনো শিক্ষার্থীর শোভা পায় না; কিন্তু সে অস্ত্রের মুখে পড়ছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। বারবার এ দেশের শিক্ষার্থীরা দেশের সংকটময় সময়ে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছে, দিয়েছে তাজা রক্ত। কিন্তু বারবার সেই শিক্ষার্থীরাই চরম অবহেলা এবং সংকটময় জীবনের মধ্যে পড়ে যায়। এই ঘটনা শুধু চবির জন্যই নয় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকেও তাকালেও আমরা দেখতে পারি স্থানীয়দের কাছে হামলা এবং বঞ্চনার শিকার শিক্ষার্থীরা।
গত ৩০ আগস্ট, শনিবার রাতে চবির দুই নম্বর গেটসংলগ্ন এলাকায় একটি মেসে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্রী নির্দিষ্ট সময়ের কিছুক্ষণ পর মেসের ভবনে প্রবেশ করতে চাইলে ভবনের দারোয়ান তাকে বাধা দেন। একই সঙ্গে অকথ্য ভাষায় গালাগাল এবং শিক্ষার্থীর গায়ে হাত তোলে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাতভর চবি শিক্ষার্থী এবং স্থানীয়দের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলে। এতে আহত হন একের পর এক শিক্ষার্থী। স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র উপচে পড়ে, গুরুতরদের পাঠাতে হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। শিক্ষক, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, প্রক্টরÑ কারও শরীরই রক্ষা পায়নি। পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিছুক্ষণের জন্য এসে পরিস্থিতি সামাল দিলেও রাতভর থমথমে এক পরিবেশ বিরাজমান থাকে ওই এলাকার। একই ঘটনার জের ধরে আজ দুপুর ১২.২০ মিনিটে আবারও এলাকাবাসী এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে কয়েক দফা সংঘর্ষ ঘটে। স্থানীয়রা শিক্ষার্থীদের ওপর দফায় দফায় ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। দা, রামদা, ছুরি, লাঠি, নানা ধরনের দেশীয় আস্ত্রের প্রয়োগ করতে দেখা যায়। কতটা হিংস্রভাবে ধানক্ষেতে ফেলে রেখে জনসম্মুখে তারা শিক্ষার্থীকে রামদা দিয়ে কুপিয়েছে সেই ভিডিও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। স্থানীয়দের হাত থেকে বাঁচতে রক্তাক্ত অবস্থায় কয়েকজন শিক্ষার্থীকে প্রাণ বাঁচাতে পাশের পুকুরে ঝাঁপ দিতে দেখা যায়। পুকুরের পানি শিক্ষার্থীদের রক্তে রক্তবর্ণ ধারণ করে। শুধু শিক্ষার্থী নয়, এই ঘটনায় আহত হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শিক্ষক, স্টাফসহ আরও অনেকে।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের বৈরিতা, ক্যাম্পাসে নিরাপত্তার অভাব এবং প্রশাসনের সময়োপযোগী পদক্ষেপের ঘাটতি এই সংঘর্ষগুলোর পেছনে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, পুলিশ প্রশাসন এক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুলিশকে বারবার ফোন করা হলেও তারা কেউই ঘটনাস্থলে আসেনি। ঘটনাস্থল থেকে ক্যান্টনমেন্ট খুবই কাছে তবুও সেনাবাহিনী সময়মতো ঘটনাস্থলে পৌঁছায়নি। কোনো রূপ সাহায্য সহযোগিতা কিংবা পরিস্থিতি সামালের ব্যাপারে ছিল তারা ছিল নীরব।
প্রশাসনের কাছে প্রশ- কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অসহায় হয়ে রক্ত ঝরাবে, আর রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চুপচাপ বসে থাকবে? এটি কি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নাকি পূর্বপরিকল্পিত?
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য নিজেই অভিযোগ করেছেন, ছাত্রলীগের একটি অংশ এই সংঘর্ষে সক্রিয় ছিল। যদি সত্যিই তা-ই হয়, তবে প্রশ্ন দাঁড়ায়- বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি রক্তক্ষয়ী ঘটনায় কি রাজনৈতিক ছত্রছায়া নেই?
বিশ্ববিদ্যালয় কেবল ডিগ্রি অর্জনের জায়গা নয়। এটি ভবিষ্যৎ প্রজš§ গড়ার কারখানা। সেই জায়গায় যদি ছাত্রদের মাথা ফাটে, শিক্ষক রক্তাক্ত হন, আর প্রশাসন বলে ‘পুলিশ আসেনি’ তাহলে এ ব্যর্থতার দায় কে নেবে? কিছুদিন আগের গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে অতর্কিত হামলায় সেনাবাহিনী যেভাবে দ্রুততম সময়ে নেতাকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করেছিল, ঠিক একই ভাবে কেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিতের ব্যাপারে তারা অপারগ হন? তাহলে কি প্রশাসন, সুরক্ষা, নিরাপত্তা শুধুই রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের জন্য?
বারবার একই দৃশ্য, একই রক্ত, একই হাহাকার। তবু প্রশাসনের ঘুম ভাঙে না। প্রতিবারই তারা বলেÑ ‘দুঃখজনক ঘটনা’, ‘তদন্ত হবে’, ‘ব্যবস্থা নেয়া হবে’- এর বেশি কিছু নয়।
আমাদের গণমাধ্যমগুলোও ডাকসু নির্বাচন নিয়ে যতটা আগ্রহী, একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর এরূপ নিশংস হামলা নিয়ে তাদের একটুখানি ও মাথাব্যথা নেই। দিন বদলায়, দেশ আর বদলায় না।
চবি শহর থেকে দূরে হওয়ায় শিক্ষার্থীরা খাদ্য, মেস, রিকশাÍসবকিছুতেই নির্ভরশীল স্থানীয়দের ওপরও। সেই নির্ভরশীলতাকে সুযোগ হিসেবে নিয়েই বছরের পর বছর তৈরি হয়েছে এক অঘোষিত আধিপত্য। দোকানদার, বাড়িওয়ালা, পরিবহন শ্রমিকÑ সবাই যেন শিক্ষার্থীদের ওপর কর্তৃত্ব বিস্তারের অধিকার রাখে।
এরই সুযোগ নিয়ে কিছু সুবিধাবাদী অপরাজনীতি চালায় আর বলি হয় নিরীহ সাধারণ জনগণ আর দেশের সূর্য সন্তানেরা। মা তার আদরের সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞ্যান-অর্জনের জন্য পাঠায় আর সেই সন্তানকে মায়ের কোলে ফিরতে হয় রক্তাক্ত আর নিথর দেহে।
শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের বেশকিছু স্বনামধন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেমন- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ও এ রকম হাজারও ঘটনার সাক্ষী। এখানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘাতের ঘটনা প্রায়শই শোনা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণগুলো কিছুদিন পরপরই স্থানীয়দের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘাতের মুখে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। মেস ভাড়া, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসদাচরণ, স্বেচ্ছাচারিতা, খাবারের দাম ও পরিবহন সমস্যা নিয়ে প্রায়শই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘাত হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে ভেজালে এর আগে শত শত শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন খুব করুণভাবে। কেউ কেউ হাত, চোখ কিংবা অঙ্গ হারানোর পথেই ছিল প্রায়। কিন্তু সব ঘটনাকে হার মানাবে চবি শিক্ষার্থীকে কুপিয়ে হাতের কনুই থেকে নিচের অংশ কেঁটে ফেলার মতো ঘটনা। আবার কুপিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দেয়ার মতো ঘটনাও। কি ভয়াবহ রকমের হিংস্রতা। পড়াশোনা করতে পাঠিয়ে বাবা-মা যদি আদরের সন্তানকেই হারিয়ে ফেলে তাহলে একদিন এদেশে পড়াশোনাও বন্ধ হবে হয়ত। স্থানীয় প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ এ বিষয়কে আরও উত্তপ্ত করে তোলে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। তবে প্রতিবারই প্রশাসন থাকে নিশ্চুপ, এক নীরব দর্শক। বলি হয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
একদিকে শিক্ষার্থীদের অধিকার, অন্যদিকে স্থানীয়দের অসৌজন্যমূলক আচরণ, ও নানারকমের বিরোধের ঘটনা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও শিক্ষার পরিবেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
এত অগনিত রণক্ষেত্র দেখেও কি প্রশাসনের ঘুম ভাঙবে না, নাকি আরও কিছু লাশ গুনতে হবে আমাদের?
আসলে প্রশাসন সব ব্যাপারে হাতে চুড়ি পড়ে বসে থাকে। অথচ রাজনৈতিক ব্যক্তির গায়ে সামান্য আঘাত লাগলে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করতে দ্বিধাবোধ করে না। এ কেমন সরকার? এ কেমন প্রশাসন যারা মশা মারতে কামান দাগে কিন্তু দেশের মেধাবীদের রাস্তায়, মাঠে-ঘাটে ফেলে মারতে একটুও কুণ্ঠিত হয়না… এর আসলে শেষ কোথায়?
প্রশাসনের কঠোর নজরদারি, দ্রুত পদক্ষেপ, সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ ও প্রয়োজনীয় সচেতনতা ও সৌহার্দ্য সৃষ্টিই পারে এ রকম অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি কমিয়ে আনতে। সতর্কতা জোরদার করা, পারস্পরিক সহানুভূতিশীলতা সমাজে শান্তি সম্প্র্রতি বয়ে আনতে। এছাড়াও অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা এড়াতে দরকার প্রয়োজনীয় মনিটরিং ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত সিসিটিভি ক্যামেরাও ইমারজেন্সি হেল্পলাইন সার্ভিস। তার থেকেও বেশি দরকার সময়মতো নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন। যেন ডাক্তার আসার আগে রোগী মারা গেল-এর মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
আসলে কারও একার পক্ষে সমাজের এতবড় আমুল পরিবর্তন সম্ভব নয়, সর্বস্তরে মানুষের পারস্পারিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই সংঘাতের নিরসন সম্ভব।
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Discussion about this post