সুধীর বরণ মাঝি : জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অর্থের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাÑএগুলো নিশ্চিত করতে অর্থের দরকার হয়। টাকা ছাড়া আজকের সমাজে জীবনধারণ প্রায় অসম্ভব। কিন্তু প্রশ্ন হলোÑএকজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সত্যিই কত টাকা দরকার? সেই টাকার জন্য কি অপরকে হত্যা করতে হবে? টাকা নিজে কখনও খারাপ নয়; এটি কেবল একটি বিনিময় মাধ্যম। কিন্তু যখন টাকার প্রতি অন্ধ আসক্তির জš§ হয় টাকা তখন মানুষকে অমানবিক করে তোলে, তখনই জš§ নেয় অপরাধ, হত্যা ও সহিংসতা। যে টাকা আমাকে দুর্নীতিবাজ বা অপরাধী করে তোলে, সেই টাকা আমার প্রয়োজন নেই। আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমের সংবাদ প্রতিবেদনে দেখি, টাকার জন্য সন্তান পিতা-মাতাকে, স্বামী তার স্ত্রীকে এবং স্ত্রী তার স্বামী খুন করছে। টাকার জন্য এই হচ্ছে সমাজের চিত্র। কারণ জীবনধারণের জন্য টাকার প্রয়োজন সীমিত, কিন্তু লোভ অসীম। আমাদের দেশেব বর্তমান সময়ে প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ অপরাধ সংঘটিত হয় অর্থের কারণে।
মানুষের মৌলিক চাহিদা কয়েকটি খাবার, মাথার ওপর একটি নিরাপদ ছাদ, প্রাথমিক চিকিৎসা এবং শিক্ষা। এগুলো ছাড়া জীবন নিরাপদ বা মর্যাদাপূর্ণ হয় না। ন্যূনতম এসব চাহিদা পূরণ করতে অর্থের প্রয়োজন হয়। তবে এর বাইরে যে অতিরিক্ত ভোগ বা বিলাসিতা, তা বেঁচে থাকার জন্য নয়; বরং সামাজিক প্রতিযোগিতা বা মানসিক তৃপ্তির অংশ। বাস্তবতা হলোÑপ্রতিদিনের তিন বেলা খাবার, একটি বাসস্থান এবং স্বাস্থ্যসেবার ব্যয়ই মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট। এর বাইরে সম্পদ কেবল জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক, কিন্তু টিকে থাকার শর্ত নয়। আজকের সমাজে আমরা দেখি, টাকার নেশা আমাদের ব্যক্তিগত জীবন, সামাজিক জীবন, জাতীয় উন্নয়ন ও উন্নতি ধ্বংসেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই বেঁচে থাকার জন্য কোটি কোটি টাকার নেশার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন অভাব পূরণের টাকার সঙ্গে সহমর্মিতা, সৌহার্দ্যবোধ, সম্প্রীতির মানসিকতা।
মানুষের প্রয়োজন সীমিত হলেও লোভ সীমাহীন। লোভই মানুষকে আইন ভঙ্গ করায়, অন্যের অধিকার হরণ করায়, এমনকি খুনের মতো জঘন্য অপরাধে প্রলুব্ধ করে। অথচ ইতিহাস সাক্ষীÑসবচেয়ে ধনী মানুষও মৃত্যুর পর শূন্য হাতেই পৃথিবী ছেড়ে গেছেন। টাকা কারও সঙ্গে যায় না। আজকের সমাজে আমরা টাকার নেশায় এতটাই অন্ধ যে জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ভুলে যাচ্ছি। টাকা অর্জনের প্রতিযোগিতায় আমরা মানবিক শক্তিকে কবর দিয়ে অমানবিক হয়ে উঠছি। আমাদের এই প্রবণতা কেবল বর্তমানকেই নয়, ভবিষ্যৎ প্রজš§কেও ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মাদকাসক্তি, বোধহীনতা ও জাতীয় চেতনাহীনতাÑএসবই টাকার মোহে দিকভ্রান্ত সমাজের পরিণতি। আমাদের মনে রাখতে হবে, টাকা মানুষের জীবনে অপরিহার্য, কিন্তু সেটি কখনোই মানবিকতার ঊর্ধ্বে নয়। আজ আমরা দেখছি, টাকার লোভ মানুষকে দুর্নীতিবাজ করছে, অপরাধের পথে ঠেলে দিচ্ছে। মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, খুন-খারাপিÑএসব অপরাধের মূলে প্রায়ই টাকার অন্ধ লালসা কাজ করে। শুধু তাই নয়, এই অমানবিক অর্থলোভ আমাদের আগামী প্রজš§কে বিপথে ঠেলে দিচ্ছে।
সমাজে টাকার প্রভাব স্পষ্ট। যাদের পকেট ভারী, সমাজ তাদের কাছে নম্র ও সহনশীল হয়। অথচ প্রকৃত সম্মান অর্জিত হওয়া উচিত সততা, নৈতিকতা ও মানবিকতার মাধ্যমে। টাকার দাপটে যখন সামাজিক অবস্থান নির্ধারিত হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই দুর্নীতি, অবিচার ও বৈষম্য বিস্তার লাভ করে। আমরা ভুলে যাচ্ছি জীবনের আসল উদ্দেশ্য। টাকার পেছনে অন্ধভাবে দৌড়াতে গিয়ে আমরা মানবিক শক্তিকে কবর দিয়ে ফেলছি। অর্থ আমাদের আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর ও নির্মম করে তুলছে। এর ফল ভোগ করছে আমাদের আগামী প্রজš§। তারা হয়ে উঠছে মাদকাসক্ত, বোধহীন ও জাতীয় চেতনাহীন। আমরা টাকার জন্য দৌড়াতে গিয়ে জীবনের সৌন্দর্য ও লক্ষ্যকে ভুলে যাচ্ছি। অথচ প্রকৃত শিক্ষা আমাদের শেখাতে পারেÑকতটুকু যথেষ্ট এবং কোথায় লোভের সীমা টানতে হবে। যদি সমাজে ন্যায়, সমতা ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে টাকার জন্য খুন বা সহিংসতার প্রশ্নই আসবে না। প্রতিটি মানুষের প্রাপ্য হলো ন্যূনতম চাহিদা পূরণের মতো অর্থ। যদি সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা যায়, তবে কেউ বঞ্চিত হবে না, আর অপরকে হত্যা করার প্রয়োজন পড়বে না। এর জন্য দরকার ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতি ও সামাজিক ন্যায়বিচার। আমরা ভুলে গেলে চলবে নাÑটাকা জীবনের সাথি হতে পারে, কিন্তু মৃত্যুর সাথি নয়। জীবনের শেষ প্রান্তে গিয়ে কেউই টাকাকে সঙ্গে নিতে পারে না। তাই টাকার জন্য মানবিকতা বিসর্জন দেয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
টাকা ছাড়া বাঁচা যায় না, কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য শুধু টাকার প্রয়োজনে খুন করারও প্রয়োজন নেই। প্রকৃত প্রয়োজন মেটানোর মতো অর্থ প্রতিটি মানুষের প্রাপ্য, আর তা নিশ্চিত করা সম্ভব সঠিক বণ্টন ও ন্যায়ের মাধ্যমে। সমাজে ন্যায়, সমতা ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই টাকার মোহে অপরাধের প্রবণতা কমানো সম্ভব। অতএব আমাদের সবার প্রতিজ্ঞা হওয়া উচিত ‘টাকার জন্য নয়, মানবিকতার জন্য বাঁচব। আমরা যদি নিজেদের সীমা ও প্রয়োজন সম্পর্কে সচেতন হই, তবে টাকার জন্য অপরাধী হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পাবে। টাকার নেশার যে আসক্তি তৈরি হয়েছে তা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে আমাদের সম্মুখ সামনে ভয়ংকর অন্ধকার অপেক্ষা করছে। মানুষে মানুষে সকল সম্পর্ক বিচ্ছন্ন হবে, মানুষ হয়ে উঠবে ভয়ংকর এক একটা দানব; যা আমরা কখনোই চাই না। আমরা যদি টাকার প্রতি নেশা ও আসক্তি না হয়ে মানবতা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতাকে ধারণ করতে পারি তবেই সমাজে ভয়, হিংসা, সহিংসতা দূর হয়ে সম্প্রীতি বিরাজ করবে; যা প্রত্যেক মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন মানুষেরই কাম্য। প্রয়োজন সামাজিক সচেতনা, ন্যায়বোধ, পাড়ায়, পাড়ায় পাঠাগার গড়ে তোলা এবং অবৈধ উপায়ে যেন কোনোভাবেই অতিরিক্ত টাকা উপার্জন করতে না পারে, সে জন্য আইনের সঠিক ও যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। পাঠ্যপুস্তক এবং শিক্ষার মাধ্যমে মানুষকে চিন্তাশীল, সৃজনশীল এবং মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
শিক্ষক, হাইমচর সরকারি মহাবিদ্যালয়, চাঁদপুর

Discussion about this post