নুরুন্নাহার চৌধুরী কলি : প্রতিটি দেশের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কিছু স্লোগান, যা আন্দোলনকারীদের দাবি আদায়ের ভাষা হয়ে উঠত, রক্তে জোয়ার এনে দিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের ইতিহাসের সঙ্গেও জড়িত ছিল এমন ‘রক্তে আগুন লাগা’ বেশ কিছু স্লোগান। এভাবে স্লোগান তৈরির চর্চা এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে।
আগে যেখানে স্লোগান ছিল প্রতিবাদের, সচেতনতার কিংবা অধিকার আদায়ের হাতিয়ার, সেখানে এখন কিছু স্লোগান হয়ে উঠেছে বিদ্বেষ, বিদ্রুপ এবং সহিংসতার উৎস। বর্তমান সময়ের কিছু জনপ্রিয় কিন্তু বাজে স্লোগান যেমন, ‘ধর্ষকের জন্য বিচার নয়, গুলি করো’, ‘ফাঁসি চাই’, ‘গার্লফ্রেন্ড মানেই চরিত্রহীন’, কিংবা ‘মেয়ে রাতে বাইরে মানেই খারাপ’, ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার’, ‘টিনের চালে কাউয়া’, ‘তারেক জিয়ার … (প্রকাশ-অযোগ্য এসব শুধু কথামালাই নয়, বরং মানুষের মননে বিষ ঢালার মাধ্যম হয়ে উঠেছে।’
বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্লোগান তৈরি করে। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই স্লোগান অনেক সময় ভিন্ন দিকে মোড় নেয়।
মিডিয়া ও ট্রেন্ডের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া: টেলিভিশনের টকশো, নাটক, কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার রিল বা স্ট্যাটাসে কিছু শব্দ বা বাক্য ভাইরাল হয়ে যায়। একশ্রেণির মানুষ এগুলো না বুঝেই ছড়িয়ে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ধর্ষণের ঘটনার পরে ‘গুলি করে দাও’ টাইপ স্লোগান হঠাৎ ছড়িয়ে পড়ে সামাজিব যোগাযোগমাধ্যমে, ইউটিউবে, এমনকি রাস্তায় পোস্টারে।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য: অনেক সময় রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী জনসাধারণকে উসকে দিতে কিছু চড়া স্লোগান ব্যবহার করে। এতে সাধারণ মানুষ উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং আইন নিজ হাতে তুলে নেয়ার মানসিকতা তৈরি হয়। সম্প্রতি ‘তারেক জিয়ার …’ চরম অশ্লীলতা ও ঘৃণার স্লোগান । এটা এমন এক ধরনের স্লোগান, যেখানে অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে রাজনীতির প্রতিপক্ষকে দমন করা হয়। এটা শুধু ঘৃণা নয়, চরম অপমানের প্রকাশ। কিছু সমাবেশে এসব স্লোগান জনসমক্ষে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে শিশুরাও উপস্থিত থাকে।
পরবর্তী প্রজন্মে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। যেমনটা ধরেন, রাজনীতিকে দেখবে কুৎসা, গালি, বিদ্বেষের জায়গা হিসেবে। অপমান-অপদস্ত করলেই জিতে যাওয়া যায়। এই ভুল শিক্ষা নিয়ে বড় হবে। নেতাদের প্রতি সম্মান নয়, বিদ্বেষ পুষে রাখবে।
এই স্লোগান একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে তৈরি করা হলেও সময়ের ব্যবধানে এটার অপব্যবহার হয়েছে।
আসল উদ্দেশ্য: যুদ্ধাপরাধীদের বিরোধিতা করা। কীভাবে বিকৃত হলো: এখন যার সঙ্গে মতের অমিল, তাকেও ‘রাজাকার’ বলে আক্রমণ করা হয় কোনো দালিলিক প্রমাণ ছাড়াই।
সত্য ইতিহাস আর রাজনৈতিক অপপ্রচারের মধ্যে পার্থক্য করতে পারবে না। ‘রাজাকার’ শব্দটা হয়ে যাবে গালি, ইতিহাস নয়। দেশপ্রেমকে আর যুক্তির জায়গা থেকে দেখবে না, বরং আবেগ-উত্তেজনার মোড়কে।
ধর্ষককে গুলি করো এই স্লোগানটা একটা ভয়ংকর মানসিকতার প্রতিফলন। এর পেছনে রাগ আর হতাশা থাকলেও এই স্লোগান বিচারব্যবস্থাকে অস্বীকার করে একধরনের পেশিশক্তিকে উৎসাহ দেয়।
মেয়েরা যদি রাতে ঘুরে বেড়ায়, সমস্যা তাদেরই এই স্লোগান একেবারে প্রতিক্রিয়াশীল ও নারীবিদ্বেষী। এটি নারীদের চলাফেরা, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার অধিকারকে খর্ব করে।
প্রতিটি অপরাধের পরে ‘ফাঁসি চাই’ বলে চিৎকার করা হয়, কিন্তু এর পেছনে থাকে না কোনো যুক্তিপূর্ণ বিচারপ্রক্রিয়ার দাবি। বরং এটা একধরনের বিচারবহির্ভূত অসহিষ্ণু মানসিকতা গড়ে তোলে।
নারীদের পোশাক নিয়ে অনেক অশ্লীল স্লোগান দিতেও দেখা যায়। এই সেøাগান সমাজকে দুই ভাগে ভাগ করে একদিকে তথাকথিত ‘ভদ্র মেয়ে’, অন্যদিকে ‘খারাপ মেয়ে’। এর ফলে ধর্ষণের শিকার মেয়েদের দায় চাপানো হয় তাদের পোশাক, চলাফেরা বা বন্ধুত্বের ওপর।
‘মব এক্সেসি’ শব্দটা অনেক মানুষের মুখে শুনা যায়। মব এক্সেসি মানে হলো একটি ভিড় যখন হঠাৎ করে যুক্তিবোধ হারিয়ে ফেলে, তখন তারা চিৎকার করে, আক্রমণ করে, আর নিজেরাও বোঝে না তারা কী করছে। এখন সোশ্যাল মিডিয়াই হলো সেই ভিড়ের নতুন রূপ।
‘মন্তব্য’ আর ‘রিঅ্যাকশন’-এর উৎপাদনা: কেউ কিছু পোস্ট করলেই শত শত মানুষ কোনো প্রমাণ ছাড়া ঝাঁপিয়ে পড়ে ‘ধর্ষক’, ‘অপরাধী’, ‘খারাপ মেয়ে’ বলে গালি দেয়। যারা কিছু বলে না, তারাও সেই নীরব ভিড়ের অংশ হয়ে যায়।
লাইভ ভিডিও আর বিচারবহির্ভূত উত্তেজনা: অনেক সময় কোনো অপরাধের ঘটনা ঘটলে মানুষ বিচার না চেয়ে তা লাইভ করে ছড়িয়ে দেয়। কেউ কেউ অপরাধী সন্দেহে পিটিয়ে মারে। এসবই সেই মব এক্সেসির নমুনা।
এই স্লোগানের ভয়ংকর সামাজিক প্রভাব: যখন কেউ বলে ‘আইন দিয়ে কিছু হবে না’, তখন সেটা আদালত ও বিচারব্যবস্থার প্রতি অবিশ্বাস ছড়ায়। মানুষ বিচার না চেয়ে প্রতিশোধ চায়।
নারীদের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়: রাতের বেলা বের হওয়া, একা ভ্রমণ, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা। সবকিছু নিয়েই নারীদের গালমন্দ করা হয়, যেন তারা নিজের স্বাধীনতা ভুলেই গিয়েছিল!
তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে: এসব স্লোগান তরুণদের মনে একধরনের ঘৃণা, ভুল মূল্যবোধ এবং রূঢ়তা গেঁথে দেয়। তারা শেখে না যুক্তি, সংবেদনশীলতা বা মানবিকতা।
সাধারণ মানুষ কী বলছে?
ভবিষ্যতের দৃষ্টিভঙ্গি: অনেকের মতে, ‘এইসব স্লোগান সমাজের হতাশা ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এগুলোর পেছনে একটা ব্যর্থ আইনব্যবস্থা কাজ করছে।’ আবার অনেকে বলছে, ‘তীব্র প্রতিবাদের জন্য মাঝে মাঝে এমন স্লোগান দরকার হয়, তবে সেটা যেন সহিংসতা উসকে না দেয়।’
শিক্ষিত শ্রেণির অনেকেই মনে করেন, ‘এভাবে ভাবলে সমাজ একদিন বিচারবহির্ভূত হত্যার দিকেই এগোবে।’ মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, ‘এইসব স্লোগান অপরাধীদের বিচার পাওয়ার অধিকার হরণ করে এবং নিরপরাধরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
অনেকের মতে, শিক্ষা ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে মানুষের মাঝে সচেতনতা ছড়াতে হবে। প্রথমত, দ্রুত, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলা গেলে মানুষ আর ‘গুলি করো’, ‘ফাঁসি চাই’ বলবে না। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভায়োলেন্ট কনটেন্ট বা উসকানিমূলক মন্তব্যের বিরুদ্ধে নিয়মকানুন ও নিয়ন্ত্রণ দরকার।
এই যৌক্তিক স্লোগানের বিকল্প হতে পারে ‘বিচার চাই’, ‘সুরক্ষা চাই’, ‘নারীর নিরাপত্তা চাই’এই ধরনের স্লোগান বেশি কার্যকর ও মানবিক।
স্লোগান সমাজের আয়না হতে পারে, আবার সমাজকে ভুল পথে টেনে নিতেও পারে। আজকের দিনে আমরা যেসব বাজে, হিংস্র ও পক্ষপাতদুষ্ট স্লোগান ছড়াচ্ছি, তা আমাদের ভবিষ্যতের মানবিক সমাজের স্বপ্ন ধ্বংস করে দিতে পারে।
আরআর/