নিজস্ব প্রতিবেদক : ২০২১ সালের শেষদিকে পুঁজিবাজার তালিকাভুক্ত হয়েছিল ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানি একমি পেস্টিসাইড লিমিটেড। তখন একাধিক ভুল তথ্য দিয়ে তালিকাভুক্ত হয়েছিল কোম্পানিটি। তালিকাভুক্তির পর প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) অর্রে ভিন্ন খাতে ব্যবহার, নির্দিষ্ট সময়ে আইপিও র্অ ব্যবহারে ব্যর্থতা, পরিচালকরে স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ব্যবসা করা, এক আইপি দিয়ে শতাধিক বিনিয়োগকারীর উপস্থিতি দেখানো, বেনামে অর্থ স্থানান্তর, হিসাব জালিয়াতি, ভুয়া ব্যাংক হিসাব, সঠিক সময়ে লভ্যাংশ ও কারসাজিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ভবন নির্মাণের কাজ দেয়ার মতো নানা অনিয়মের প্রমাণ পায় বাংলাশে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তবে রহস্যজনক কারণে একমি পেস্টিসাইডের উদ্যোক্তা পরিচালকদের শাস্তির আওতায় আনা হয়নি।
বিএসইসি সূত্রে জানা যায়, সংস্থাটি ২০২১ সালের ১৯ জুলাই প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ৩০ কোটি টাকা তোলার অনুমোদন দেয় একমি পেস্টিসাইডসকে। অভিহিত মূল্য ১০ টাকা ামে তিন কোটি সাধারণ শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে এই পরিমাণ টাকা তোলার সুযোগ পায় কোম্পানিটি। তবে এই টাকা সঠিক সময়ে ব্যবহারে ব্যর্থ হয় উদ্যোক্তারা। গত কয়েক বছরের একমি পেস্টিসাইডের নানা অনিয়ম ও অর্থ অপব্যবহার নিয়ে তদন্তে নামে বিএসইসি। গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর কমিশন তদন্ত কমিটি গঠন করে। এ কমিটি চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেন। এ তদন্ত প্রতিবেদন বলা হয়, এ উত্তোলিত অর্থ থেকে সাউথইস্ট ব্যাংকের লা মেরিডিয়ান শাখায় ২৬ কোটি টাকা আমানত করা হয়েছিল। আর আমানত লিয়েন রেখে (বন্ধক) একমি পেস্টিসাইডের উদ্যোক্তাদের একটি র্স্বাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান শান্ত অ্যাগ্রো অ্যান্ড ট্রেডিং ফার্মের নামে ১৩ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়।
এই ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতায় ব্যাংক আমানত থেকে ঋণের টাকা সমন্বয় করে। একই ব্যাংক থেকে অবশিষ্ট আইপিও টাকার বিপরীতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজাউর রহমান সিনহার ছেলে শরীফ সিনহার মালিকাধীন প্রতিষ্ঠান শরীফ ট্রেড সংস্থার নামে সাত কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়। এ শরীফ ট্রেড আবার একমি পেস্টিসাইডের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এবং যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী ও স্থাপনকারী হিসেবে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানও বৈদ্যুতিক স্থাপনার নামে দুই কোটি ৪৮ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়। অথচ আইপিও টাকা থেকে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা ন্যাশনাল ফাইন্যান্স থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধের কথা থাকলেও পুরো ঋণ পরিশোধ করেনি। উল্টো খেলাপি হয়েছে। এমনকি মামলার আসামিও হয়েছে। যদিও আইপিওতে আসার আগে ঢাকা ব্যাংকের হিসাব বিবরণী জাতিয়াতির প্রমাণ পায় কমিশন। এছাড়া আইপিও টাকা থেকে ১০ কোটি টাকা দিয়ে নতুন কারখানা ভবন ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণের জন্য পুঁজিবাজারে বির্তকিত বিনিয়োগকারী ও কারসাজিতে জড়িত বিশ্বজিৎ দাশকে ১০ কোটি টাকা দেয়া হয়। এরই মধ্য বিশ্বজিৎ দাশের মালিকানাধীন বন্ধন এন্টারপ্রাইজকে ২ কোটি ২৭ লাখ টাকা এবং কোয়ান্টাম ইন্টারন্যাশনালকে ৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা দেয়া হয়।
শেয়ার কারসাজির দায়ে ২০১৯ সালে ১২ সেপ্টেম্বর বিশ্বজিৎ দাশের বিও তহবিল উত্তোলন ও স্থানান্তর এবং লিংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে শেয়ারগুলো স্থানান্তর বন্ধ করা হয়। বিশ্বজিৎ দাশ ও তার স্ত্রীর সব বিও লেনদেন স্থগিত করা হয়।
জানা গেছে, ওই ১০ কোটি ৩ লাখ টাকা ব্যয়ের হিসাব সঠিক সময়ে সঠিকভাবে নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন ও আইপিও ইউটিলাইজেশন রিপোর্টে প্রকাশ করা হয়নি। অথচ গত বছরে ২৪ জুন কমিশনের তদন্ত দল ভবন নির্মাণের কোনো কার্যক্রম দেখতে পায়নি। আইপিওর টাকায় নতুন ভবন নির্মাণের কথা বলা হলেও গত চার বছরে এ ভবন নির্মাণের দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। এমনকি পুরোনো ভবনকে রেস্ট হাউজ হিসাবে ব্যবহার করছেন পরিচালকরা। এ জায়গার কোম্পানির কোনো সাইনবোর্ডও পাওয়া যায়নি। একই জায়গায় ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি দেখা যায়। এছাড়া কনজুমার ব্র্যান্ড ইউনিটের অস্তিত্ব পায়নি তদন্তকারী দল। এসব নিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারী ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ভুল তথ্য দেয় একমি পেস্টিসাইড লিমিটেড। এমনকি অপকর্মের বৈধতার জন্য আইপিও ফান্ডের টাকা ব্যবহারে সময় বাড়ানোর জন্য ৫১ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারী উপস্থিত দরকার হলে কোম্পানি তা পরিপালনে ব্যর্থ হয়। এর জন্য সাইবার প্রতারণায় আশ্রয় নেয় একমি পেস্টিসাইড। একই লগিং আইপি আইডি ব্যবহার করে এজেন্ডার পক্ষে ১২৭ জন বিনিয়োগকারীর অবৈধভাবে ভোট দেয়ার তথ্য প্রমাণ পায় কমিশন। এমন ২৮টি লগিং আইপি আইডি ব্যবহার করে এক হাজার ২৪৬ জন বিনিয়োগকারী ভুয়া উপস্থিত দেখানো হয়। এসব বিনিয়োগকারীর মোট শেয়ার সংখ্যা দেখানো হয় ৪ কোটি ৭ লাখ। ডিএসইর আইটি বিভাগ এর প্রমাণ পায়।
এত সব অনিয়ম করেও আইপিওর মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ সাড়ে তিন বছরের মধ্যেও ব্যবহার করতে পারেনি একমি পেস্টিসাইডস কর্তৃপক্ষ। কোম্পানিটির আইপিওতে সংগ্রহ করা ৩০ কোটি টাকার সম্পূর্ণ ব্যবহারের সময়সীমা ছিল ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এখন পর্যন্ত আইপিওর অব্যবহৃত ফান্ড রয়েছে ৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা বা ২৭ শতাংশ।
আরো জানা যায়, একমি পেস্টিসাইডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সিনহা সিকিউরিটিজ লিমিটেডের গ্রাহক হিসাবে ঘাটতি ও নানা অনিয়মের কারণে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা সিইওরে ব্যাংক হিসাব ও বিও হিসাব জব্দের নির্শে দিয়েছে বিএসইসি। পাশাপাশি বিদেশ ভ্রমণেও দেয়া হয়েছে নিষেধাজ্ঞা।
খেলাপি ঋণ বিষয়ে ন্যাশনাল ফাইন্যান্সে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেন, একমি পেস্টিসাইডের নামে নেয়া ঋণ বর্তমানে খেলাপি হয়ে রয়েছে। এ ঋণ নেয়ার সময় একমি ল্যাবরেটরি নামে করপোরেট গ্যারান্টিও দেয়া হয়; যা পরে ভুয়া হিসাবে প্রমাণ পাওয়া যায়।
এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দাবি, এ ঋণ আদায়ে বিএসইসি উচিত একমি ল্যাবরেটরি পরিচালক পারভীন আকতার খানমের ৭৫ লাখ শেয়ার বিক্রি করে ন্যাশনাল ফাইন্যান্সের পাওনা আদায়ে সুযোগ দেয়া। একইভাবে সাধারণ বিনিয়োগকারী আইপিওর টাকা ঘাটতি এ টাকা থেকে পূরণের সুযোগ আছে। কারণ নাসির উর রহমান সিনহা তখন একমি ল্যাবের চেয়ারম্যান ছিলেন।
বেশ কয়েকজন বিনিয়োগকারী বলেন, গত সাড়ে তিন বছরেও একমি পেস্টিসাইড ২৬ কোটি টাকার সঠিক হিসাব দিতে পারেননি। উল্টো এসব টাকা নানা উপায়ে ও ভুয়া হিসাবের মাধ্যমে সরিয়ে নেন উদ্যোক্তারা। কারখানা ভবন, মেশিন, নতুন উৎপাদন ইউনিট চালু করার কথা ছিল। কমিশন এসব বিষয়ে অনেকটা নীরব। কমিশনের উচিত স্বাধীন বডি বা ট্রাস্টের মাধ্যমে কোম্পানি পরিচালনা করা। আর উদ্যোক্তারে সঠিক শাস্তি দিয়ে পুঁজিবাজারে সুশাসন নিশ্চিত করা। এছাড়া একমি পেস্টিসাইডের দায় ও দেনা সঠিক চিত্র প্রকাশ করা; যাতে বিনিয়োগকারী সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
এ বিষয়ে একমি পেস্টিসাইডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজাউর রহমান সিনহার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা সেলিম রেজা শেয়ার বিজকে বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানে কমিশন তদন্তকারী ল এসেছিল। তারা বেশ কিছু বিষয় অনিয়ম পেয়েছে। আমরা এসব বিষয়ের উত্তর দিয়েছি। তবে টাকা ছাড়া প্লেসমেন্ট বরাদ্দ দেয়ার কোনো বিষয় নেই। আর আইপিও টাকা পুরোপুরি ব্যবহার শেষ করার জন্য আরো সময় লাগবে। আমরা সময় বাড়ানোর জন্য ইজিএম করব।
একমি পেস্টিসাইডসের অনুমোদিত মূলধন ১৫০ কোটি ও পরিশোধিত মূলধন ১৩৫ কোটি টাকা। বি-ক্যাটেগরি কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের ৩১ দশমিক ৮০ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগাকারীদের ১৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৫৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।

Discussion about this post