মো. ফজলুল হক : রাজধানী যখন ডেঙ্গু সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছে তখন নীরবে সারাদেশ তটস্থ করে রেখেছে যক্ষ্মা। ডেঙ্গুর যত খবর পাওয়া যায় যক্ষ্মার ব্যাপারে ততটা আমরা দেখি না। কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ ও মৃত্যুর মিছিলে যক্ষ্মা কয়েক গুণ এগিয়ে। দেশের কভিড-১৯ এরপর সবচেয়ে বেশি অকাল মৃত্যু হয়েছে যক্ষ্মায়। কিন্তু এত ভয়ানক হয়েও কেন সচেতনতার বাইরে এই মহামারি?
গত শতাব্দীর আশির দশকে প্রথম পাশ্চাত্য দেশগুলো ভয়ানকভাবে সংক্রমিত হয় যক্ষ্মায়। ফলশ্রুতিতে ১৯৯৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যক্ষ্মাকে বৈশ্বিক জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণা করে। তার পরই বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগ এনজিওগুলোকে সঙ্গে নিয়ে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। বিগত সময়ে গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণাসহ যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে শক্ত হাতে মাঠে নামলেও যথাযথ সাফল্য আসেনি তিন দশকেও। জয়েন্ট মনিটরিং মিশনের (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত যক্ষ্মা সার্বিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ ছাড়াও কিছু দেশে এটা কার্যকর আছে) এর সর্বশেষ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০৩০ সাল নাগাদ বছরে আক্রান্তের সংখ্যা ৭০ হাজার ও মৃত্যুর সংখ্যা ছয় হাজারে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বর্তমানে সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে নেই বাংলাদেশ। সরকারের সর্বশেষ হিসাব বলছে, প্রতিবছর প্রায় তিন লাখ ৭৯ হাজার মানুষ নতুন করে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়। প্রতিবছর মারা যান ৪৪ হাজার। অর্থাৎ প্রতিদিন এক হাজার ৩৮ জন নতুন রোগী যোগ হচ্ছেন এবং মারা যাচ্ছে ১২১ জন। একত্রে প্রতিদিন দেশজুড়ে মাতৃমৃত্যু, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও আত্মহত্যায় সম্মিলিত মৃত্যুর চেয়েও অনেক বেশি মৃত্যু হচ্ছে যক্ষ্মায়! ফরিদপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে ফরিদপুর জেলায় এক ৮১৩ জন রোগী শনাক্ত হয়। ২০২৪ সালে দুই ৭৫৯ জন এবং ২০২৫ সালের ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত শনাক্ত হয় তিন হাজার ৮২ জন। এতে দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৫ সালে রোগী বেড়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ। এই বৃদ্ধি অস্বাভাবিক। একই ফলাফল দেখা গেছে পার্শ্ববর্তী মাদারীপুর, গোপালগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি জেলায়। সামগ্রিক বাংলাদেশের অবস্থানও আহামরি আলাদা নয়।
তিন দশকেও যক্ষা নিয়ন্ত্রণের ভয়ানক ব্যর্থতা বিশেষজ্ঞ মহলে উদ্বেগ তৈরি করেছে। যক্ষ্মার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়াকে মূলত দুইভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। প্রথমত, রোগীর অনিচ্ছা বা অসচেতনতা, দ্বিতীয়ত কর্তৃপক্ষের যথাযথ সমন্বয়ের ব্যর্থতা।
যক্ষ্মা হলো—মাইকোব্যাক্টেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ঘটিত বাবুবাহিত সংক্রামক ব্যাধি (সংক্ষেপে টিবি), যা প্রধানত ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। ফলে রোগীর রক্তযুক্ত থুতু বা শ্লেষ্মা, দীর্ঘস্থায়ী কাশি, জ্বর, রাত্রিকালীন ঘাম হয় ও ওজন হ্রাস পায়। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি ও থুতুর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, সহজেই সংক্রমিত হয় এইডস আক্রান্ত ও ধূমপায়ী ব্যক্তিরা। যক্ষ্মার প্রাথমিক চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় উপকরণ সংবলিত নির্দিষ্ট-মাত্রার একক ট্যাবলেট প্রদান করা হয়। সব ফুসফসীয় যক্ষ্মার রোগীর টানা ছয় মাস ধরে ওষুধ খেতে হবে। তবে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের যক্ষ্মা হলে ১২ মাসের চিকিৎসাও প্রয়োজন হতে পারে।
যক্ষ্মার সবচেয়ে ভয়ংকর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া ওষুধপ্রতিরোধী হয়ে উঠলে একে নিয়ন্ত্রণে আনা বেশ কষ্টসাধ্য। প্রাথমিক রোগীর চিকিৎসায় ওষুধের মান ও সেবনের নিয়ম ঠিক না থাকলে, পূর্ণ মেয়াদে ওষুধ সেবন না করলে যক্ষ্মার জীবাণু ওষুধপ্রতিরোধী হয়ে ওঠে, যা সাধারণ ওষুধে আর যক্ষ্মা ভালো হয় না। ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মারোগী সরাসরি যক্ষ্মার জীবাণু ছড়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর পাঁচ হাজার মানুষ নতুন করে ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়, যার অর্ধেক শনাক্ত হচ্ছে না। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মার রোগী বাড়ছে। যক্ষ্মার জীবাণু ছড়াতে ধূমপান, হাঁচি-কাশি এবং পরিশেষে ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে রোগীর যথাযত আগ্রহের অভাব এই রোগ ছড়িয়ে দিতে অনেকাংশেই দায়ী।
বাংলাদেশে যক্ষ্মা নির্ণয়, চিকিৎসা ও ওষুধ সবই বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। তার পরও দেশে যক্ষ্মা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি কেন এর উত্তর আজও ধোঁয়াশা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন রোগী ও তার আশপাশের মানুষের অসচেতনতাই যক্ষ্মা ছড়িয়ে পড়তে বড় ভূমিকা রাখছে।
দ্বিতীয়ত, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে কেন্দ্র ও মাঠপর্যায়ে সমন্বয়হীনতা থাকায় কর্তৃপক্ষ এই রোগের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারছে না। এর পেছনে রয়েছে বহুমাত্রিক অব্যবস্থাপনা। প্রথমত, দেশের জাতীয় পর্যায়ের যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ওপর সরকারের বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কম। জাতীয় কর্মসূচি হলেও যক্ষ্মার সম্মুখভাগের কাজ করে মূলত এনজিওগুলো। যক্ষ্মারোগী শনাক্ত, ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মারোগী শনাক্ত, শনাক্ত রোগীদের চিকিৎসার আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে। যেমন- বছরে নতুন রোগী হয় তিন লাখ ৭৯ হাজার। লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে সারাদেশ থেকে মোট নতুন রোগীর ৯০ শতাংশ বা তিন লাখ ৪১ হাজার ১০০ জনকে শনাক্ত করতে হবে। দেশে ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মারোগীর অনুমিত সংখ্যা পাঁচ হাজার। কিন্তু শনাক্ত হয় দুই হাজারের কম। উপর মহলের চাপ থাকায় এ সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানো হয়। বিপুল এই কাজের আঞ্জাম দিতে গিয়ে হিমশিম খায় এনজিওগুলো। কিছু ক্ষেত্রে এক নমুনা দিয়ে একাধিক ব্যক্তিকে রোগী দেখানো হয়, যা প্রকৃত রোগের অবস্থা সম্পর্কে সব হিসেব-নিকেশে গরমিল তৈরি করে।
গত বছর সঠিক রোগ নির্ণয় ও ভুল মানুষকে ওষুধ না খাওয়াতে পুনঃপরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। এ বছর আগস্টে ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মার ৮৪ জন রোগীর নমুনা আবার পরীক্ষা করে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সংক্রামক রোগ শাখা। পুনঃপরীক্ষায় ৮৪ জনের মধ্যে ১১ জনের দেহে ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মার জীবাণু ছিল না। অর্থাৎ ১৩ দশমিক ১ শতাংশ মানুষের রোগ শনাক্ত সঠিক ছিল না। কিন্তু পরবর্তী সময় দ্বিতীয়বার নমুনা পরীক্ষার এই নিয়মটি বাতিল করা স্বাস্থ্য বিভাগ। যুক্তরাষ্ট্র সরকার যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশকে আধুনিক প্রযুক্তি দিয়েছে। ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মা শনাক্ত হওয়া সব মানুষের নমুনা আইসিডিডিআরবিতে বিনা খরচে পুনঃপরীক্ষা সম্ভব। এই প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার হওয়া দরকার, যা হয়তো-বা হয়ে উঠছে না। হতে পারে মাঠপর্যায়ের পরামর্শ মেনে রোগীরা কেন্দ্রে সেবা পাচ্ছে না।
এরপর যক্ষ্মার ওষুধ সংরক্ষণ, সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনা নিয়েও কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাব থাকতে পারে। নষ্ট ওষুধ বিপজ্জনক। যক্ষ্মার ওষুধের মান ঠিক না থাকলে তা যক্ষ্মা নিরাময় না করে উল্টা ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। কয়েকটি জেলায় রোগী বৃদ্ধির প্রকৃত কারণ জানাই যাচ্ছে না। কিছু ক্ষেত্রে উপজেলা পর্যায়ে নষ্ট ওষুধ পাওয়া গেলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এর কোনো তদন্ত করেনি। এছাড়া এনজিওর হাতেই মাঠপর্যায়ের বেশির ভাগ কাজ থাকায় সরকারি হস্তক্ষেপে খুব একটা নেই। রোগীর সঠিক সংখ্যা ও সামগ্রিক রিপোর্ট ঠিকমতো জমাদান বা তদারকিতেও ঘাটতি রয়েছে। পরিতাপের বিষয়, এতটা মারাত্মক একটা রোগ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সরাসরি নেয়নি, বা অন্য কারও মাধ্যমে বাস্তবায়ন করলেও যথাযথ তদারকি করেনি।
পরিশেষে ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের যক্ষ্মা-বিষয়ক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রধানরা ২০৩০ সাল নাগাদ সংক্রমণ কমিয়ে আনার এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে যক্ষ্মামুক্ত বিশ্ব গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। একাধিক সরকারি কর্মকর্তা, এনজিও কর্মী ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মী উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যক্ষ্মার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে নেই বাংলাদেশ। এছাড়া যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিচালকদের নিয়োগ হয় খুবই কম সময়ের জন্য, কাজ বুঝে ওঠার আগেই তার অবসর হয় অথবা অন্যত্র স্থানান্তর হয়। ফলে কাজের ধারাবাহিকতা আসার আগেই পরিচালক পরিবর্তন করায় বারবার ব্যাহত হচ্ছে কাজের অগ্রগতি। সামগ্রিক এই ভারসাম্যহীনতা আমাদের যক্ষ্মার কবল থেকে বের হতে দিচ্ছে না।
সরকারি হিসাবে বর্তমানে যে ১০টি দেশে যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা বেশি, বাংলাদেশ তার অন্যতম। জাতিসংঘের ঘোষণাকে আমলে নিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে দ্রুত এই রোগের নিয়ন্ত্রণ না নিতে পারলে ভবিষ্যতে এই রোগ আরও বড় হয়ে দেখা দেবে। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৫-এ রোগীর সংখ্যা ৭০ শতাংশ বেড়ে যাওয়া কোনো ভালো কিছু ইঙ্গিত দেয় না। এতটা ভয়ানক হয়েও এই রোগ এখনো মানুষের নজরের বাইরে। দ্রুত বর্ধমান এই রোগের নিয়ন্ত্রণ নিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সরাসরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। প্রয়োজন ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মার ব্যাপারে ব্যাপক সচেতনতা। জরুরি ভিত্তিতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ ও সঠিক ব্যবস্থাপনা এখন অত্যন্ত জরুরি। না হলে ডেঙ্গু বা করোনার মতো সরবে নয়, নীরবে আত্মঘাতী এবং ছোঁয়াচে এই রোগ পৌঁছে যাবে সবার দোরগোড়ায়, তখন হয়তো আমাদের আর করার কিছুই থাকবে না।
শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
