প্রতিনিধি, সাতক্ষীরা : সুন্দরবন-সংলগ্ন সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলায় চাষ হওয়া নরম খোসার (সফটশেল) কাঁকড়া আন্তর্জাতিক বাজারে বিপুল চাহিদা তৈরি করেছে। বর্তমানে সফটশেল (নরম খোসার) কাঁকড়া সাতক্ষীরা জেলার মানুষের ভাগ্য বদলাতে শুরু করেছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এ অঞ্চলে কাঁকড়া উৎপাদনের জন্য প্রতি বছর গড়ে উঠছে নতুন নতুন খামার, যা জেলা তথা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সম্প্রতি সাতক্ষীরা জেলা সরেজমিনে পরিদর্শন করে এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে জুন মাসে কাঁকড়া রপ্তানি হয়েছে ১৩ দশমিক ৭৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত ২০২৩-২৪ র্অবছরের একই সময়ে (জুলাই-জুন) এ রপ্তানি ছিল ৯ দশমিক ২৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, এতে বিগত বছরে চেয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৮ দশমিক ৭০ শতাংশ। শুধু চলতি বছরের জুন মাসে রপ্তানি হয়েছে ১ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশ বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে চাষযোগ্য কাঁকড়ার মধ্যে শিলা কাঁকড়া অন্যতম। শিলা কাঁকড়া খোলস বলের সময় প্রায় তিন ঘণ্টা খোলসবিহীন থাকে। তখন কাঁকড়ার ওপর শুধু একটি নরম আবরণ থাকে। ঠিক সেই সময় কাকড়াঁগুলো বিক্রির জন্য উপযুক্ত হয়।
আন্তর্জাতিক বাজারে সফটশেল (নরম খোসা) কাঁকড়া উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়, যার কারণে অনেক চাষি চিংড়ি ছেড়ে এখন কাঁকড়া চাষে ঝুঁকছেন। লাভ বেশি হওয়ায় চাষিরা এখন চিংড়ি চাষ ছেড়ে কাকড়াঁয় আগ্রহ দেখাচ্ছেন বেশি। বর্তমানে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর ছাড়াও সদর উপজেলা ও কালিগঞ্জ উপজেলাসহ অন্যান্য স্থানেও সফটশেল কাঁকড়ার চাষ হচ্ছে।
কাঁকড়া চাষে পুকুরের পানির উপরিস্তর ব্যবহৃত হয়, যাতে অব্যবহৃত থাকে পানির নিচের স্তর। পুকুরের পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য কাঁকড়ার পাশাপাশি সাদা মাছ, যেমন রুই, কাতলা, তেলাপিয়াসহ নানা মাছ চাষ করে লাভবান হচ্ছেন অনেক চাষি। সফটশেল কাঁকড়া সাধারণত খাঁচা পদ্ধতিতে চাষ হয়, যাতে পানির ওপরে খাঁচাগুলোয় কাঁকড়া চাষ করলে নিচের স্তরের পানিতে সাদা মাছের চাষ করা যায়।
সফটশেল কাঁকড়া দ্রুত প্রক্রিয়াজাত ও রান্না করা যায় বলে আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদা বেশি। বর্তমানে সফটশেল কাঁকড়া চীন, ক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন এশীয় দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
কাঁকড়া শুধু সাতক্ষীরা জেলার মানুষের আয়েরই উৎস নয়, বরং কাঁকড়া চাষের মাধ্যমে এই অঞ্চলে মানুষের বেকারত্বও দূর করছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এই কাজ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
সরেজমিনে শ্যামনগর উপজেলার কয়েকটি কাঁকড়ার খামারে গিয়ে দেখা যায়, কাঁকড়ার খামারে কর্মব্যস্ত দিন কাটাচ্ছেন নারী ও পুরুষরা। কেউ ছোট ছোট করে কাটছেন কাঁকড়ার খাবার তেলাপিয়া মাছ এবং কেউ কেউ নিয়ম করে দেখছেন কাঁকড়ার খোলস পাল্টাচ্ছে কি না।
খুলনা মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সফটশেল কাঁকড়া রপ্তানিতে গত দুই অর্থবছরে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি লক্ষ করা গেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৬৪৪ দশমিক ৭৬৮ মেট্রিক টন সফটশেল কাঁকড়া রপ্তানি হয়েছিল, যার বাজারমূল্য ছিল ৮ দশমিক ০২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
পরবর্তী র্অবছর অর্থাৎ ২০২৪-২৫ সালে রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১১৬৬ দশমিক ৮৮৮ মেট্রিক টনে, যার বাজারমূল্য ছিল ১৪ দশমিক ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এতে এক বছরের ব্যবধানে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৬ দশমিক ১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে ২০২১-২২ অর্থবছরে সফটশেল কাঁকড়ার রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮০২ দশমিক ৭১৩ মেট্রিক টন, যার বাজারমূল্য ছিল ১১ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
শ্যামনগরের দুগাবাঁটি এলাকার কাঁকড়াচাষি গৌতম সরকার বলেন, ‘আমাদের এখানে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। তাই আমাদের র্অনৈতিক একটা ঝুঁকি সবসময় থাকে। চিংড়ি পোনার লবণাক্ততা সহ্য করার ক্ষমতা কম এবং পোনায় ভাইরাসের আক্রমণে এটি মারা যায়। তাই আমি এবার কাঁকড়া চাষ করেছি। তিনি বলেন, এতে তুলনামূলকভাবে লাভ বেশি হয় এবং কাঁকড়ার পাশাপাশি পুকুরে সাদা মাছ চাষ করছি, যাতে এটি থেকেও আর্থিকভাবে কিছুটা লাভবান হওয়া যায়।’ একই এলাকার চাষি সৌরভ সরকার বলেন, ‘আমাদের এই অঞ্চলের সবাই সফটশেল কাঁকড়া চাষ করছেন। আমি এই মৌসুমে ৭০০ খাঁচায় তৈরিতে খরচ হয়েছে তিন লাখ টাকা। বাজার ভালো থাকলে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকায় বিক্রি করতে পারব। বর্তমানে ‘এ’ গ্রেডের সফটশেল কাঁকড়া প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকায়, ‘বি’ গ্রেডের ৬৫০ টাকায়, আর ‘সি’ গ্রেডের ৫০০ টাকায়।’
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জিএম সেলিম বলেন, ‘সফটশেল কাঁকড়ার উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমরা বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। চাষিদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে, যাতে তারা আধুনিক ও টেকসই পদ্ধতিতে কাঁকড়া চাষ করতে পারেন। তিনি বলেন, তবে বর্তমানে সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকায়, চাষিরা কাঁকড়ার পোনা সংগ্রহে কিছুটা সমস্যায় পড়ছেন। এই সংকট মোকাবিলায় সরকারিভাবে তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা ও সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে।