দেশের অন্যতম গর্বের প্রতিষ্ঠান পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। এ প্রতিষ্ঠানের অনেক সুনাম রয়েছে। আরইবির অধীন ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির (পিবিএস) মাধ্যমে সারা পল্লী এলাকা আলোকিত করে আরইবি সারা বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছে। কর্মচারী-কর্মকর্তা নিয়োগেও আরইবি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। যোগ্যতা থাকলে অর্থ ও তদবির ছাড়া এখানে যে কোনো পদে চাকরি পাওয়া যায়। প্রতিষ্ঠানটির কেনাকাটাতেও বড় কোনো অনিয়ম বা অভিযোগ নেই। সেই প্রতিষ্ঠান নিয়ে তিন বছর আগে শুরু হয়েছিল ষড়যন্ত্র। হাসিনা সরকারের পতন হলেও আরইবি ও পিবিএসের দ্বন্দ্ব এখন চরমে। এ নিয়ে শেয়ার বিজের তিন পর্বের ধারাবাহিকের শেষ পর্ব
মীর আনিস : পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) নিয়ে চলছে ষড়যন্ত্র। এটি সফল হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে গ্রামীণ অর্থনীতি ও গ্রামের ১১ কোটি মানুষ। এছাড়া চাকরি হারাবেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির (পিবিএস) ৩৫ হাজার কর্মচারী। শেয়ার বিজের অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে এসেছে।
জানা গেছে, আরইবির ৩ কোটি ৭০ লাখ গ্রাহকের মধ্যে ২ কোটি ৩০ লাখ গ্রাহককে ক্রয় মূল্যের চেয়ে কম দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। লাইফ লাইন এই গ্রাহকদের সুবিধাভোগী ১১ কোটি মানুষ। তারা প্রতি ইউনিট ৪ টাকা ৬৩ পয়সা দরে বিদ্যুৎ পায়। গ্রামের কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশাওয়ালা মাসে ২০০ টাকার মধ্যে ঘর আলোকিত করে এবং বৈদ্যুতিক পাখার বাতাসে আরাম করে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি কোম্পানি হলে অথবা এটি বেসরকারি খাতে চলে গেলে এত কম দামে তারা বিদ্যুৎ পাবে না। খরচ তখন দুই থেকে তিন গুণ বেড়ে যাবে। পাশাপাশি কোম্পানি হলে লাইনম্যান, মিটার রিডার ও বিলিং সহকারীরা চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে। কোম্পানি আউটসোর্সিং করে এসব কাজ সমাধান করবে।
পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) দেশের অন্যতম মডেল প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের কাঠামো জবাদিহিমূলক, গ্রাহকবান্ধব ও গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের কল্যাণমুখী। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কারণেই হাসিনা আমলে এখানে তেমন কোনো দুর্নীতি হয়নি। এখানে দুর্নীতি করার সুযোগও নেই। তাছাড়া আরইবির ৪০ শতাংশের সিস্টেম লস ৮ দশমিক ১৪ শতাংশে নেমে এসেছে।
আরইবি সূত্র জানায়, গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন ও সার্বিকভাবে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরইবির ভূমিকা অপরিসীম। গ্রামীণ কৃষি, সেচ ও কুটির শিল্পের বিপ্লবের অন্যতম মাধ্যম পল্লী বিদ্যুৎ। প্রায় এক লাখ হাঁস-মুরগির খামারও চলে পল্লী বিদ্যুতের বিদ্যুৎ দিয়ে। কৃষি উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নেও পল্লী বিদ্যুতের অবদান অসীম।
বিদ্যুৎ বিভাগের একটি সূত্র জানায়, আরইবির মডেল প্রতিষ্ঠান পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। সেখানে কর্মচারী-কর্মকর্তারা সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়ে বেশি বেতন পান। সুযোগ-সুবিধাও বেশি। সমিতি নিজেরাই কর্মচারী-কর্মকর্তা নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি দিতে পারে। তাদের আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা অনেক বেশি। একজন জিএম নিজস্ব ক্ষমতা বলে ২০ লাখ টাকার নির্মাণ কাজ ও ক্রয় করতে পারেন। অথচ সরকারি দপ্তরে এসব করতে গেলে বছরব্যাপী ফাইল চালাচালি ও অনুমোদনের প্রয়োজন হয়।
এ বিষয়ে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির একজন অবসরপ্রাপ্ত জিএম নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, আন্দোলনকারীরা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির স্বার্থ দেখছে না। তারা নিজেদের স্বার্থ দেখছে। তাদের অবস্থা অনেকটা ‘সুখে থাকলে ভূতে কিলানোর মতো।’ না হলে কেন তারা নিজের পায়ে কুড়াল মারার মতো আন্দোলনে নামবে। বেতন নিয়ে তাদের কোনো অভিযোগ নেই। সুযোগ-সুবিধা নিয়েও কোনো অভিযোগ নেই। অথচ তারা আলাদা হতে চায়। কোম্পানিতে যেতে চায়। তা না হলে তারা আরইবির সঙ্গে একীভূত হতে চায়। কিন্তু আরইবির সঙ্গে একীভূত হতে গেলে প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে, অনেকের বেতন কমে আসবে। এসব বিষয় নিয়ে কোনো চিন্তা নেই।
এদিকে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি আলাদা হলে বা কোম্পানি হলে গ্রাহকের খরচ বাড়বে। পাশাপাশি হয়রানিও বাড়বে। বর্তমান মডেল অনুযায়ী গ্রাহকদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। কিন্তু কোম্পানি হলে জবাবদিহি থাকবে না। বাড়বে নৈরাজ্য। এমনই আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্টরা।
আরইবির সাম্প্রতিক সমস্যার বিষয়ে চেয়ারম্যানকে মোবাইলে কল ও ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের জনসংযোগ পরিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) তামান্না কবীর শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা কোনো মতামত দিই না। সবাই মতামত চাচ্ছে কিন্তু আমরা কাউকেই মতামত দিইনি। পত্রিকার লেখা আমরা পড়ি ও দেখিÑতারপর কোনো কিছু করা লাগলে সেটা আমরা সমাধান করি।’
সামিট গ্রুপের জনসংযোগ প্রধান মহসেনা হাসান আন-অফিসিয়ালি অনেক কথাই বলেন। তবে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, সামিটের কোনো অফিসিয়াল বক্তব্য নেই।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান শেয়ার বিজকে বলেন, পল্লী বিদ্যুতের সমস্যাগুলোর সমাধানে আমরা দুটি কমিটি করেছিলাম। তাদের জমা দেয়া প্রতিবেদনে তিন হাজার কর্মীর চাকরি পুনর্বহালের
সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে থেকে আমরা প্রথম পর্যায়ে এক হাজার কর্মীর চাকরি পুনর্বহালের উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু এমন সময়েই কেন গণছুটির কর্মসূচিতে যেতে হবে, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, ‘আমরা প্রত্যাশা করছি এ ধরনের অস্থিরতা দ্রুত নিরসন হবে। এ ধরনের কার্যক্রমের কারণে মানুষের দুর্দশা ও ভোগান্তি বাড়ছে। আমরা আশা করব কর্মকর্তারা বিষয়টি অনুধাবন করবেন।’