আমানুর রহমান খোকন, কুড়িগ্রাম : দীর্ঘ সময় ধরে ভারত থেকে শুধু পাথর ও কয়লা আমদানির ওপর টিকে আছে সোনাহাট স্থলবন্দর। সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও অন্যান্য পণ্য আমদানি না হওয়ায় ১৩ বছরেও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেনি দেশের ১৮তম এই স্থলবন্দরটি। এ বছর থেকে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে হতাশা কাজ করছে। এই পরিস্থিতিতে বন্দরের কার্যক্রম বাড়াতে বন্দর দিয়ে মানুষ পারাপারের ইমিগ্রেশন সুবিধাসহ অনুমোদিত সব পণ্যের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম পুরোদমে চালুর দাবি করছেন উত্তাঞ্চলের মানুষ ও সোনাহাট স্থলবন্দরের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
জানা যায়, দেশের সীমান্তঘেঁষা কুড়িগ্রাম জেলা শহরের ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সোনাহাট স্থলবন্দর। দারিদ্র্যপীড়িত জেলার মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের লক্ষ্যে ভারত-বাংলাদেশের পণ্য আমদানি ও রপ্তানির জন্য ২০১৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোর প্রবেশপথে সোনাহাট স্থলবন্দর চালু করা হয়। যাতে কুড়িগ্রাম জেলা দিয়ে বাংলাদেশি পণ্য এবং ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোর যথাক্রমে আসাম, মেঘালয়, মনিপুর, মিজোরাম, অরুনাচল, ন্যাগাল্যান্ড এবং ত্রিপুরা রাজ্য হয়ে ভারতীয় পণ্য আমদানি করা সহজ হয়।
কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারী উপজেলার ১০ কিলোমিটার বঙ্গ সোনাহাট ক্যাম্পের মোড়ে ১৪ দশমিক ৬৮ একর জমির ওপরে ২০১৬ সালে সোনাহাট স্থলবন্দরের অবকাঠামোর নির্মাণকাজ শুরু করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে এই স্থলবন্দর এলাকায় ৬০০ টন ধারণক্ষমতাসম্পন একটি ওয়্যারহাউস, ৯৫ হাজার বর্গফুটের ওপেন স্টকইয়ার্ড, ৯৬ হাজার বর্গফুটের পার্কিং ইয়ার্ড, শ্রমিকদের জন্য দুটি বিশ্রামাগার, দ্বিতল ডরমিটরি ও একটি প্রশাসনিক ভবন রয়েছে। এই বন্দরের জিরো পয়েন্ট থেকে আসামের কোচবিহারের দূরত্ব ৬৫ কিলোমিটার, মেঘলায় রাজ্য ৩৫০ কিলোমিটার, শিলং ৩৫০ কিলোমিটার ও ভুটানের দূরত্ব ১৬০ কিলোমিটার। বর্তমানে এই বন্দরে উন্নত মানের অবকাঠামো এবং দুই দেশের দূরত্ব সবটাই অনুকূলে থাকলেও বন্দরের মূল উদ্দেশ্য ভেস্তে যেতে বসেছে। বন্দরে শুরু থেকেই ভারতীয় পাথর, কয়লা, তাজা ফল, ভুট্টা,গম, চাল, ডাল, আদা, পেঁয়াজ ও রসুনÑএই ১০টি পণ্য আমদানি করার অনুমোদন থাকলেও বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা পুরোপুরি সেই সুযোগ পায়নি। শুধু আমদানি করা হচ্ছে ভারতীয় পণ্য পাথর ও কয়লা। বাকি পণ্য আমদানির জন্য কোনো সুযোগ সৃষ্টি করেননি ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। এতে ভারতের সরকারও আশানুরূপ ভূমিকা রাখেনি। অপরদিকে নিষিদ্ধ পণ্য ছাড়া বাংলাদেশের সকল পণ্য রপ্তানি করার অনুমোদন থাকলেও দেশের ব্যবসায়ীরা বন্দরের সৃষ্টিলগ্ন থেকেই তা থেকে বঞ্চিত ছিলেন। তবে সবেমাত্র রপ্তানি করতে শুরু করা হয়েছিল বাংলাদেশের জুট ওয়েস্ট কটন, সিনথেটিক নেট, গার্মেন্ট পণ্য, আকিজের ফ্লাইউড ও প্লাস্টিকের কিছু কিছু পণ্য। এতেই সোনাহাট স্থলবন্দরে বছরে গড়ে আয় হতো প্রায় ১৫ কোটি টাকার মতো। এখন এই বন্দরের সব রপ্তানি বন্ধ আছে। শুধু আমদানি করা হচ্ছে পাথর ও কয়লা, তাও নামমাত্র। গত এক সপ্তাহে এই বন্দরে গড়ে আমদানিকৃত পণ্য পাথরের ট্রাক এসেছে ২০টি ও কয়লা এসেছে দুটি। ব্যবসায়ী মোখলেছুর রহমান, আবুল হোসেন ব্যাপারী ও নুর আলম বলেন, বন্দরের পরিবেশ অনেক ভালো থাকলেও আমরা শুরু থেকেই ব্যবসায় তেমন সুবিধা করতে পাইনি। বন্দর এলাকায় শুধু শুধু জায়গা জমির ভাড়া দিচ্ছি। বর্তমানে কিছু পাথর আসছে, কয়লা নেই বললেও ভুল হবে না। অনুমোদন থাকলেও অন্য কোনো পণ্য আমরা এই বন্দরে আমদানি করতে পারিনি। কিছু পণ্য রপ্তানি করতে শুরু করেছি মাত্র। আর এরই মধ্যে রপ্তানি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এখনও আমরা এই বন্দর থেকে কোনো ব্যবসায়ী আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারিনি। শুধু লোকসানের খাতা ভর্তি হয়েছে। পুরোদমে আমদানি-রপ্তানি শুরু হলে বন্দর এলাকার মানুষের অনেক কর্মসংস্থান হবে। ব্যবসাসহ আর্থিকভাবে লাভবান হবেন লাখ লাখ মানুষ। মিজু মিয়া, বকুল ইসলাম ও আ. রহিম বলেন, আমরা বন্দরে মালামাল লোড -আনলোড করে জীবীকা নির্বাহ করে থাকি। ঢিলাঢালাভাবে বন্দর চলায় আমাদের বেকার বসে থাকতে হয়। এতে আমরা পারিবারিক খরচ চালাতে হিমশিম খাই। রুনা দাস ও কুলসুম বেওয়া বলেন, আমরা বন্দর এলাকার আশপাশের মানুষ শ্রমিকের কাজ করে জীবন বাঁচাই। রপ্তানি বন্ধ এবং অল্প আমদানি হওয়ায় আমরা তেমন কাজ পাই না। সন্তানদের নিয়ে আমাদের অনাহারে থাকতে হয়। সোনাহাট স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক মো. এফেখারুল ইসলাম শ্যামা বলেন, ৫ আগস্টের পর এই সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এই সংগঠনের সঙ্গে প্রায় ৩০০ ব্যবসায়ী যুক্ত আছেন। বন্দরে শুধু পাথর ও কয়লা আমদানি করা হয়। সেই আমদানিও বন্দরের এলাকা অনুপাতে অনেক কম। রপ্তানি বন্ধ থাকায় ব্যবসায়ীদের দিন ভালো যাচ্ছে না। আমরা এই বন্দরের অনুমোদিত সব ভারতীয় পণ্য আমদানি করাসহ দেশীয় সব অনুমোদিত পণ্য রপ্তানি করতে চাই। সেই সঙ্গে চাই মানুষ পারাপারের ইমিগ্রেশন। এতে আমরা যেমন লাভবান হব, তেমনি লাভবান হবে সরকার ও দেশের সব মানুষ। সোনাহাট স্থলবন্দর কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক মো. জাহাঙ্গীর আলম আকমল বলেন, এই বন্দরে আমরা ৫২ জন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট নিযুক্ত আছি। আমদানি ও রপ্তানি তেমন না থাকায় বন্দরে শুধু ১০-১২ জন এজেন্ট নিয়মিত কাজ করে থাকি। অনুমোদিত ভারতীয় ১০টি পণ্য এবং বাংলাদেশের অনুমোদিত সব পণ্য পুরোদমে আমদানি ও রপ্তানি শুরু হলে বন্দর জাঁকজমকের সঙ্গে চলবে। তাহলে সরকারের রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে বন্দরসহ আশপাশের হাজার হাজার মানুষ আর্থিকভাবে লাভবান হবেন।
সোনাহাট স্থল শুল্ক স্টেশন রাজস্ব কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম জানান, বন্দরে এখন মাসে গড়ে ২৫-২৬টি ট্রাক ভারতীয় পণ্য নিয়ে আসে। এখন রপ্তানি বন্ধ, তাই তেমন কোনো কর্মব্যস্ততা নেই এই বন্দরে। আমরা ভারতীয় আমদানিকৃত পাথর ও কয়লার মাফ অনুযায়ী চালানের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করে থাকি। আমদানি ও রপ্তানি বৃদ্ধি পেলে বন্দরের ব্যবসা বাড়বে, এতে আমাদের রাজস্ব বাড়বে। কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক সিফাত মেহনাজ বন্দর পরিদর্শনকালে বলেন, স্থলবন্দরের কার্যক্রম আরও গতিশীল ও আধুনিকায়ন করতে হবে। সঠিক নিয়মে বন্দর চললে সবাই উপকৃত হতে পারব। বন্দরের আমদানি ও রপ্তানির বিষয়টি দুই দেশের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে হয়ে থাকে।
প্রিন্ট করুন







Discussion about this post