নিজস্ব প্রতিবেদক : আর্থিক খাতে পূর্ণ স্থিতিশীলতা ফেরাতে সময় লাগবে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে গতকাল সোমবার অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ স্টেট অব দ্য ইকোনমি, ২০২৫’ ও ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাংলাদেশ অগ্রগতি প্রতিবেদন, ২০২৫’ শীর্ষক প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের মুখেও ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।
তিনি বলেন, ‘সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আর্থিক খাত এখন একটি টেকসই ভিত্তির দিকে এগোচ্ছে এবং সেখানে দৃশ্যমান অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে।’
গভর্নর বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের সময় দেশে দ্রুত অবমূল্যায়িত মুদ্রা, কমে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বেড়ে যাওয়া খেলাপি ঋণ, তারল্য সংকট ও ব্যাহত বাণিজ্যপ্রবাহের মতো সংকট বিদ্যমান ছিল।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতাম, বিনিময় হার স্থিতিশীল না হলে মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয় সম্ভব নয়।’ দায়িত্ব গ্রহণের সময় প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল প্রায় ১২০ টাকা, যা বর্তমানে পুরোপুরি বাজারভিত্তিক ব্যবস্থায় স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে।
ড. মনসুর বলেন, দেশের বৈদেশিক খাত এখন ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত, আর্থিক হিসাবেও ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি এবং সামগ্রিক পরিশোধ ভারসাম্য এখন উদ্বৃত্ত রয়েছে। তিনি জানান, এক বছর আগে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেখানে প্রায় ১৭ বিলিয়ন (১ হাজার ৭০০ কোটি) মার্কিন ডলারে নেমে এসেছিল, সেখানে বর্তমানে তা প্রায় ১০ বিলিয়ন (১ হাজার কোটি) ডলার বেড়েছে।
সুদহারের বিষয়ে গভর্নর স্পষ্ট করে বলেন, এখনই সুদের হার কমানোর কোনো সুযোগ নেই। মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমে ৮ শতাংশের একটু ওপরে নেমে এলেও বাস্তব সুদহার সামান্য ইতিবাচক রাখার প্রয়োজন রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, ‘মুদ্রানীতি পুরোপুরি বাজারভিত্তিক থাকবে। সুদহারে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ নেই।’
সরকারের ঋণ গ্রহণের চাহিদার কারণে অর্থবাজারে কিছুটা চাপ তৈরি হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক কোনোভাবেই অর্থ ছাপার পথে যায়নি বলে জানান গভর্নর।
তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে খেলাপি ঋণের (এনপিএল) পরিমাণ দীর্ঘদিন ধরে কম দেখানো হচ্ছিল। স্বচ্ছতা আনার পর দেখা গেছে, প্রকৃত খেলাপি ঋণের হার ৩৫ শতাংশেরও বেশি, যা স্বীকার করতে অস্বস্তিকর হলেও এটি বাস্তব সত্য।
তবে তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে খেলাপি ঋণে উল্লেখযোগ্য হ্রাস লক্ষ করা যাবে।
গভর্নর জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে ১৪টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে, পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে এবং ৯টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবসান প্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছে। পাশাপাশি আমানত বিমা আইন, ব্যাংক রেজোলিউশন অধ্যাদেশ ও ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনসহ গুরুত্বপূর্ণ আইনি সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের পথে রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন ও জবাবদিহিতা জোরদার করতে বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশও পর্যালোচনার আওতায় আনা হয়েছে।
ড. মনসুর বলেন, একীভূত নতুন ব্যাংকগুলো প্রাথমিক মূল্যায়ন অনুযায়ী প্রথম বা দ্বিতীয় বছরের মধ্যেই লাভজনক অবস্থায় যেতে পারে। লোকসানি প্রতিষ্ঠানের জন্য ‘লভ্যাংশ নয়, বোনাস নয়’ নীতিমালা কঠোরভাবে কার্যকর রয়েছে।
যেসব কর্মকর্তা প্রদত্ত ঋণ দ্রুত খেলাপিতে পরিণত হয়েছে, তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে বলেও জানান তিনি।
গভর্নর বলেন, বড় ঋণখেলাপিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানও অর্থায়নের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়নি। বিদ্যুৎ ও বড় শিল্প খাতে হঠাৎ উৎপাদন বন্ধের ঝুঁকি থাকায় সমন্বিত উদ্যোগে সেগুলো সচল রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বৈদেশিক খাত পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে আর্থিক খাতে পূর্ণ স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সময় লাগবে। আমরা যে কাঠামোগত ও আইনি সংস্কার শুরু করেছি, তা অব্যাহত থাকতে হবে এবং আমরা আশা করি আগামী সরকার এসব সংস্কার কার্যক্রম বজায় রাখবে।’
প্রিন্ট করুন







Discussion about this post