মীর আনিস : উদ্ভাবনী কৌশল ও নতুন নতুন ব্যবসার ধারণা নিয়ে কাজ করা ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড দ্রুত গ্রাহকরে মনে জায়গা করে নেয়। তবে গুটিকয়েক ব্যক্তির কারণে প্রতিষ্ঠানটি বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়ে এবং সুনাম নষ্ট হয়। এর পেছনে ছিল ডেসটিনি ২০০০-এর উদ্যোক্তা রফিকুল আমীনের ভাতিজা আশরাফুল আমিন। তিনি একাই ডেসটিনি ২০০০-এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশন থেকে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও বিনিয়োগকারীরে সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যই পাওয়া যায়। তবে আশরাফুল আমিন শেয়ার বিজকে বলেন, আমি ট্রি প্লান্টেশন লিমিটেডের কোনো গাছ বিক্রি করে টাকা হাতিয়ে নেব এমন কোনো সুযোগই নেই। এসব অভিযোগ অসত্য। চাইলে তদন্ত করে দেখতে পারেন।
অন্যদিকে অভিযোগকারীরা বলছেন, বাংলাদেশের জনপ্রিয় এই নেটওয়ার্ক মার্কেটিং কোম্পানির ৩৭টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশন লিমিটেড। যেখানে দেশের কয়েক লাখ বিনিয়োগকারী তাদের কষ্টার্জিত অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। প্রতিশ্রুতি ছিল, বাগানে গাছ রোপণ করে তা বিক্রির মাধ্যমে মূলধন ও মুনাফাসহ টাকা ফেরত দেয়া হবে। কিন্তু গ্রাহকদের মূলধনসহ মুনাফার টাকা আত্মসাৎ করেছে একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশন লিমিটেডের কয়েক লাখ বিনিয়োগকারী। এদের একজন আশরাফুল আমিন। এখান থেকে বের হতে হলে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে বিনিয়োগকারীদের।
বিনিয়োগকারীদের ভাষ্য, ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশন লিমিটেডের বাস্তব চিত্র ভয়াবহ। তারা জানান, লোকমুখে শোনা যাচ্ছে ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশনের একটি ৩০ কোটি টাকার মূল্যবান বাগান মাত্র ১২ কোটিতে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। আর ওই টাকা ভাগাভাগি করে নিয়েছে প্রতারক চক্র। সংঘবদ্ধ এই প্রতারক নিজেরে আখের গোছাতে প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
এদিকে এক যুগ জেল খেটে বের হয়েও নিজের ভাতিজার কারণে প্রতিষ্ঠানটির পূর্ণ দায়িত্ব নিতে পারছেন না ডেসটিনির প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীন। সম্প্রতি তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘জেল থেকে বেরিয়ে অফিসে বসে পরিকল্পনা করে সবকিছু গুছিয়ে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেখানেও ষড়যন্ত্র করে আমাকে অফিসে ঢুকতে দেয়া হয়নি। নিজের লোকেরাই গাদ্দারি করে আমাকে অফিসের বাইরে রেখেছে।’
অভিযোগে বলা হচ্ছে, ট্রি প্লান্টেশনের বাগান বিক্রির সঙ্গে সরাসরি জড়িত রয়েছেন ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের হাইকোর্ট মনোনীত বোর্ড পরিচালক কামরুল হাসান, মইনুদ্দিন আহমেদ, সাইফুল আলম রতন, জাহাঙ্গীর আলম, ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও শেয়ারহোল্ডার জাহাঙ্গীর আলম (ট্রেইনার), শেয়ারহোল্ডার আশরাফুল আমিন এবং হাইকোর্ট মনোনীত বর্তমান বোর্ড চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার প্রশান্ত ভূষণ বড়ুয়া। তিনি ৫ আগস্টের পর বিদেশে পালিয়ে যান। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) অভিযোগ রয়েছে। প্রশান্ত বড়ুয়াসহ একটি সিন্ডিকেট ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনায় আসার পর প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। প্রশান্তর অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন আশরাফুল আমিন। তিনি ট্রি প্লান্টেশন লিমিটেড ছাড়াও ডেসটিনির সম্পত্তি বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এখন দায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে নানা ফন্দিফিকির বের করে ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডকে অন্ধকার গহ্বরে ঠেলে দিতে মরিয়া আশরাফুল সিন্ডিকেট। লন্ডনে বসে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন প্রশান্ত বড়ুয়া। তারা কেবল ডেসটিনির বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি করছেন এমন নয়। ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড যাতে আর ঘুরে দাঁড়াতে না পারে সে ষড়যন্ত্রেও লিপ্ত চক্রটি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গাছ বিক্রির নির্দেশে পুরো কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিয়েছেন বর্তমান বোর্ড চেয়ারম্যান প্রশান্ত ভূষণ বড়ুয়া। তিনি লন্ডন থেকে নিয়মিত জুম মিটিংয়ের মাধ্যমে এই সম্পদ বিক্রির নির্শেনা দিচ্ছেন। প্রশান্তর নির্দেশ বাস্তবায়ন করছেন আশরাফুল আমিনসহ সিন্ডিকেটের সদস্যরা। এভাবে বিনিয়োগকারীরে সম্প লুটেপুটে খেয়ে তারা আছেন ফুরফুরে মেজাজে। তাদের বিরুদ্ধে নেয়া হচ্ছে না কোনো আইনি ব্যবস্থা। বিনিয়োগকারীদের উচিত এই প্রতারকরে বিরুদ্ধে মামলাসহ বিভিন্ন পক্ষেপ গ্রহণ করা। তা না হলে প্রতারকরা আস্তে আস্তে সব গাছ বিক্রি করে টাকা হাতিয়ে নেবে এমন আশঙ্কা ভুক্তভোগীদের।
এ নিয়ে আশরাফুল আমিন বলেন, ‘আমি ট্রি প্লান্টেশন লিমিটেডের দায়িত্বে আছি। প্রশান্ত বড়ুয়াও আদালতের নিয়োগপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তার সঙ্গে মিটিং করা তো দোষের কিছু না।’
বিনিয়োগকারীরে সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই সংঘবদ্ধ চক্রটি গত ১২ বছর ধরে বিভিন্ন ধাপে, বিভিন্নভাবে বাগানের গাছগুলো বিক্রির সঙ্গে জড়িত রয়েছে। পটুয়াখালী কাউয়ারচর ট্রি প্লান্টেশন লিমিটেডের বাগানের প্রায় ৫০ লাখ টাকার গাছ বিক্রি করা হয় কামরুল হাসানের নেতৃত্বে। ফাঁসিয়াখালীসহ বিভিন্ন স্থানে কোটি কোটি টাকার গাছ এবং জমি বিক্রি করে তারা নিজেরে মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে। অথচ এই সম্প ছিল বিনিয়োগকারীদের ভবিষ্যতের নিরাপত্তা।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, যখন বর্তমান বোর্ডের কিছু সৎ পরিচালক এই দুর্নীতি ও সম্প বিক্রির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, তখন তাদের প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওই দুর্নীতিবাজ চক্রের কিছু অনুসারী এসব সৎ পরিচালকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও অপমানজনক মন্তব্য করে চরিত্র হননের চেষ্টা করছে। যেন তারা ন্যায়বিচারের পক্ষে আর কণ্ঠ না তোলে।
বিনিয়োগকারীদের দাবি, এই সংঘবদ্ধ দুর্নীতির পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। জড়িত সব চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় আনা হোক। যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক। ভবিষ্যতে যেন এমন প্রতারণা আর না ঘটে, সে জন্য শাস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হোক। নইলে এদের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব নয়।
বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মতে, এখন সময় এসেছে সচেতন হওয়ার। বিনিয়োগকারীদের উচিত একত্র হয়ে এই চক্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং আইনি লড়াই শুরু করা। যাদের কারণে লাখ লাখ পরিবার অর্থনৈতিক দুর্দশায় পড়েছেন। তারা যেন কোনোভাবেই রক্ষা না পায়, সে লক্ষ্যে বিনিয়োগকারীরে পক্ষ থেকে প্রতিবা ও তদন্তের জোরালো দাবি উঠেছে।

Discussion about this post