নিজস্ব প্রতিবেদক : অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ দিয়ে এক্সিম ব্যাংক থেকে ৬১৫ কোটি ৭৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ও নাসা গ্রুপের কর্ণধার নজরুল ইসলাম মজুমদারসহ ৩০ জনের নামে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকের উপ-পরিচালক মো. আল-আমিন বাদী হয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার সংস্থাটির সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ বাদী হয়ে মামলাটি করেন। এই মামলায় নজরুল ইসলাম মজুমদারের দুই সন্তানকেও আসামি করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিরা ফ্লামিংগো এন্টারপ্রাইজ নামের অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের বাস্তবতা যাচাই/পরিদর্শন না করে, কোনো সহায়ক জামানত ছাড়াই ঋণ বিতরণ করেন। বিতরণ করা ঋণের মাধ্যমে কেনা আমদানি পণ্য সরেজমিনে পরিদর্শন ও স্টক প্রতিবেদন প্রস্তুত না করে বিতরণ করা ঋণের কোনো পরিশোধ না হওয়া সত্ত্বেও ঋণ প্রকৃত উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করে মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে ঋণের অর্থ নাসা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসেবে নগদ জমা ও ট্রান্সফার করেছেন।
আসামি নজরুল ইসলাম মজুমদারের পক্ষে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে পে-অর্ডার করার বিষয়টি এক্সিম ব্যাংক কর্মকর্তারা জানা সত্ত্বেও নিজেরা লাভবান হয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ মঞ্জুরিপত্রের শর্ত সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে। আসামি পারস্পরিক যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধমূলক অসদাচরণ ও বিশ্বাসভঙ্গ করে অবৈধভাবে ঋণ দিয়ে ৬১৫ কোটি ৭৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
নাসা বেসিকস লিমিটেডের সাবেক এমডি ওয়ালিদ ইবনে ইসলাম, আনিকা ইসলাম ছাড়াও ব্যাংকটির একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া ফ্লামিংগো এন্টারপ্রাইজের স্বত্ব¡াধিকারী মোশাররফ হোসেন, মদিনা ডেটস অ্যান্ড নাটসের প্রোপ্রাইটর মোজাম্মেল হোসাইন, জান্নাত এন্টারপ্রাইজের প্রোপ্রাইটর আবুল কালাম আজাদ, এনএমসি অ্যাপারেলস লিমিটেডের ডেপুটি এমডি আবুল কালাম ভুঁইয়া আসামি হয়েছেন। পাশাপাশি এক্সিম ব্যাংকের শীর্ষ ২৪ জন কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে মামলায়।
নজরুল ইসলামের এসব অপকর্মের কারণে তৈরি পোশাক শিল্পের লাইফলাইন খ্যাত এক্সিম ব্যাংককে ধ্বংসের মুখে পড়েছে। সাবেক চেয়ারম্যানের কারণে ব্যাংকটি ’নেগেটিভ ব্র্যান্ডিংয়ের’ মুখে পড়েছে।
এমনকি এক্সিম ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ ীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের করা অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউর (একিউআর) তথ্য মতে, এক্সিম ব্যাংকের ৫২ হাজার ৭৬ কোটি টাকার বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে ২৫ হাজার ১০১ কোটি টাকাই খেলাপি, যা মোট ঋণের ৪৮ দশমিক ২০ শতাংশ। প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ১৫ হাজার ১১৭ কোটি টাকা।
ব্যাংকটির কর্মকর্তারা বলছেন, সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের অপকর্মের কারণে এক্সিম ব্যাংককে নিয়ে অনেক সমালোচনা হচ্ছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তার অতি দালালিই এখন ব্যাংকটির জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠাতা বা পরিচালকের ভুলে পুরো ব্যাংককে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন নজরুল ইসলাম মজুমদার। এই সময়ে তিনি নিয়মিত বিভিন্ন ইস্যুতে ব্যাংক থেকে চাঁদা তুলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ত্রাণ তহবিলে জমা প্রদানে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতেন। ফলে ব্যাংক খাতের বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পান তিনি। সেই প্রভাব খাটিয়ে ২২টি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ হাজার ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। অর্থ পাচার করে সম্পদ গড়েছেন বিদেশেও। কেদন্রীয় ব্যাংক, দুদক ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) একাধিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য ওঠে এসেছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ থেকে নজরুল ইসলাম মজুমদারকে সরিয়ে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০০৭ সাল থেকে ব্যাংকটিতে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন মজুমদার। প্রায় দেড় দশক বিএবি সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ৫ আগস্টের পর বিএবির সভাপতির দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
নজরুল ইসলাম মজুমদার পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠান নাসা গ্রুপেরও চেয়ারম্যান। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নজরুল ইসলাম মজুমদারের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর রাজধানীর গুলশান থেকে নজরুলকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর থেকে তিনি কারাগারে আছেন।

Discussion about this post