নুরুন্নাহার চৌধুরী কলি : গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর তিন দিন দেশে কোনো সরকার ছিল না। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হতে যাচ্ছেÑএমন খবরে পুঁজিবাজারের সূচক বেড়েছিল। কিন্তু সরকার গঠনের পর থেকে আবার তা কমতে থাকে।
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন নিজে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। তারা বাজার বিশ্লেষণ করে ঠিক পদক্ষেপও নেয়নি। আস্থার সংকটে ভালো শেয়ারেরও তাই দর কমছে। সরকার পতন, নতুন সরকার গঠন এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় পুঁজিবাজারে বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। এ ছাড়া পুঁজিবাজারে কারসাজির সঙ্গে জড়িত অনেকের বিরুদ্ধে বর্তমান কমিশন ব্যবস্থা নেয়ায় নতুন করে বড় বিনিয়োগ হচ্ছে না। আগের বিনিয়োগকারীরাও ভয়ে সরে যাচ্ছেন বলে মনে করছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।
২০১৬ সালের ২০ জুন পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ৩২ লাখ ৭৬৬ জন থাকলেও চলতি বছরের মে মাসে এই সংখ্যা ১৬ লাখ ৯০ হাজার ২২৭ জনে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দিন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারী ছিল ১৬ লাখ ৬৮ হাজার ৮৯৫ জন।
চলতি বছরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রতিনিয়তই কমছে সূচক। বাজারে ভালো শেয়ার থাকলেও সেগুলোর দরও কমছে। পাশাপাশি আছে আরও কিছু বড় সংকট, যেসবের কারণে পুঁজিবাজারে ছড়িয়ে পড়ছে আস্থার সংকট।
এর মধ্যে দীর্ঘদিনের মন্দাবস্থা কাটিয়ে গত জুলাইয়ে ডিএসইর সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স বেড়েছিল সাড়ে ১২ শতাংশ। গত জুলাইয়ে ডিএসইএক্স সূচক ৬০৫ পয়েন্ট বেড়ে ৫ হাজার ৪৪৩ পয়েন্ট দাঁড়িয়েছে, যা ছিল সাড়ে নয় মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগের মাস শেষে সূচকটির অবস্থান ছিল ৪ হাজার ৮৩৮ পয়েন্টে। সূচকের পাশাপাশি এ সময়ে ডিএসইতে গড় লেনদেন বেড়েছে ১১৯ শতাংশ। জুলাইয়ে এক্সচেঞ্জটিতে দৈনিক গড়ে ৭৩০ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে, আগের মাসে যা ছিল ৩৪০ কোটি টাকায়।
জুলাইয়ে দেশের পুঁজিবাজারের বাজার মূলধন বেড়েছে ৪৯ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। গত জুন শেষে বাজার মূলধন ছিল ৬ লাখ ৬২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, যা জুলাই শেষে ৭ লাখ ১২ হাজার ২০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
তবে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত পাল্টা শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার খবরে দেশের পুঁজিবাজারে বড় উত্থান দেখা যায়। গত ৩ আগস্ট দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) প্রায় সব খাতেই শেয়ারের দর বেড়েছিল। একইসঙ্গে বেড়েছিল সূচক ও লেনদেনের পরিমাণ। এদিন ডিএসইতে এক হাজার ১৩৭ কোটি টাকা, যা গত এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। এরপর থেকেই পুঁজিবাজারে পতনের দ্বারা অব্যাহত।
বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে গতকাল বুধবার প্রধান উপদেষ্টার অর্থবিষয়ক বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেছিলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য এখন ভালো সুযোগ। আমাদের পুঁজিবাজারও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য প্রস্তুত। শুধু বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নয়, এই বার্তা দেশীয় বিনিয়োগকারীদের কাছেও পৌঁছে দিতে চান বলে মন্তব্য করেন তিনি।
একটি সংলাপে পুঁজিবাজার নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘কোনো গোষ্ঠীতন্ত্রের কাছে বাজারকে জিম্মি করে রাখতে দেবে না সরকার। আগে তো সব পলিসি করা হতো কিছু গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে। এভাবে লুট করায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ডাকাতদের আড্ডা হয়ে গেছে। এখানে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা কেবল প্রতারণার শিকার হয়েছেন, পুঁজি হারিয়েছেন। বিতর্ক এড়াতে ও বিশ্বমানের বাজার তৈরি করতে সরকার বিদেশি পরামর্শকের কাছ থেকে পরামর্শ নেয়ার সিদ্ধান্তে গেছে।’
গত মে মাসে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছিলেন, দেশের প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিরা পুঁজিবাজার থেকে ২০১০-১১ সালে ২০ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে। এর মধ্যে ১৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। পুঁজিবাজার নিয়ে গত জুলাই মাসে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছিলেন, দেশের পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন ধরে একটি দুষ্টচক্র সক্রিয় রয়েছে, যা বাজারের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে। এই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের একটি ‘ভালোর চক্র’ বা ভার্চুয়াস সাইকেল গড়ে তুলতে হবে। পুঁজিবাজারে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণের কারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। পাশাপাশি তাদের দক্ষতার ঘাটতিও রয়েছে। এই দুর্বলতা শুধু পুঁজিবাজার নয়, গোটা আর্থিক খাতকেই নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে।
ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমদ গত বছরের ডিসেম্বরে বলেছিলেন, পুঁজিবাজার উঠলেও আমি ভয়ে থাকি, আতঙ্কিত হই। সবাই মনে করে, আমি বাজারের ভালো চাই না। আসলে ব্যাপারটা তেমন না, ব্যাপারটা হলো শেয়ারের দর বাড়লে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পুঁজি আসে আর শেষে তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সর্বশেষ গতকাল বুধবার দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সপ্তাহের চতুর্থ কার্যদিবসে মূল্যসূচকের মিশ্রপ্রতিক্রিয়ায় সামান্য বেড়েছে লেনদেন। এদিন বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ার এবং মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিটের দর কমেছে।
ডিএসই সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। গতকাল ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের চেয়ে ‘ডিএসইএক্স’ ১ দশমিক ১১ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৫ হাজার ৩১৪ পয়েন্টে। শরিয়াহ সূচক ‘ডিএসইএস’ ৩ দশমিক ৩১ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৫৫ পয়েন্টে আর ‘ডিএস৩০’ ৫ দশমিক ৮৬ পয়েন্ট বেড়ে অবস্থান করছে ২ হাজার ৫৭ পয়েন্টে। তবে লেনদেনে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। ডিএসইতে গতকাল লেনদেন আগের কার্যদিবসের তুলনায় বেড়েছে।
দিনশেষে ডিএসইতে মোট লেনদেন দাঁড়িয়েছে ৭০৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয়েছিল ৬৬৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা।
ডিএসইর তথ্যমতে, গতকাল লেনদেন হওয়া বেশিরভাগ কোম্পানি এবং ফান্ডের শেয়ার ও ইউনিটের দর কমেছে। ডিএসইতে গতকাল মোট ৩৯৮টি কোম্পানি এবং মিউচুয়াল ফান্ডের শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ১২১টি ফান্ড ও কোম্পানির দর বেড়েছে। এর বিপরীতে ২০৩টি ফান্ড ও কোম্পানির দর কমেছে। দিনশেষে ৭৪টি ফান্ড ও কোম্পানির দর অপরিবর্তিত ছিল।

Discussion about this post