নিজস্ব প্রতিবেদক : শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের (বিনিয়োগ) ৯৫ শতাংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি ব্যাংকটির ইনভেস্টমেন্ট মনিটরিং অ্যান্ড রিকভারি বিভাগের এক প্রতিবেদনে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৬টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকটির মোট ৫১ হাজার ২৫ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে বিতর্কিত এস আলম গ্রুপ একাই বেনামি ও নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে।
জানা গেছে, ব্যাংকটির মোট ৬০ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৫৮ হাজার ১৮২ কোটি টাকাই খেলাপি, যা মোট ঋণের ৯৫ শতাংশ। এটি দেশের ব্যাংকিং খাতের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। ২০২৫ সালের মার্চ মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকটিতে প্রায় ১৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি রয়েছে।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আব্দুল মান্নানের অভিযোগ, বিগত সরকারের আমলে ব্যাংকটিতে বড় ধরনের অনিময় হয়। এখনও ব্যাংকটি পুনর্গঠনে সেসময়ের অনিয়মের সঙ্গে জড়িতরা বাধা দিচ্ছে। ইচ্ছাকৃতভাবে বকেয়া পরিশোধ করছে না।
এদিকে ব্যাংকটির একাধিক শাখা ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, গ্রাহকভেদে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকার বেশি আমানত তুলতে দেয়া হচ্ছে না। এতে গ্রাহকদের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে এবং তারা টাকা উত্তোলনের জন্য ভিড় করছেন।
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬ জন খেলাপি গ্রাহকের তালিকায় দেশের অনেক বড় বড় গ্রুপ ও কোম্পানির নাম রয়েছে। এস আলমের পাশাপাশি শীর্ষ ১০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে: দেশবন্ধু সুগার মিলস লিমিটেড (৯৬৮ কোটি), মেসার্স এমআরসি বিজনেস হাউস (৮৭৪ কোটি), মেসার্স গ্লোব ট্রেডার্স (৮০১ কোটি), তাসমিন ফ্লাওয়ার মিলস লিমিটেড (৭২৫ কোটি), মো. নুরুন নবী (৬৫৩ কোটি), মেসার্স সাফরান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল (৬৩৩ কোটি), মেসার্স লেজেন্ডারি ইন্টারন্যাশনাল (৬৩২ কোটি), এসএ অয়েল রিফাইনারি লিমিটেড (৬৩২ কোটি), মেসার্স ইমেজ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল (৫৯৮ কোটি টাকা)। এছাড়াও তালিকায় বেক্সিমকো, নাসা, অ্যানেক্স, সিকদারের মতো অনেক নামি-দামি প্রতিষ্ঠানের নামও রয়েছে।
ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে অসংখ্য অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বেনামি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ প্রদান, বিনিয়োগ সীমা অতিক্রম করে ঋণ অনুমোদন, জামানত বা বন্ধকীকৃত সম্পত্তির অস্বাভাবিক মূল্যায়ন, অনাবৃত জামানতের বিপরীতে ঋণ বিতরণ, মুনাফা মওকুফের নামে মূলধন মওকুফ। এছাড়াও রয়েছে এমটিডিআর বা স্থায়ী আমানতের বিপরীতে নিয়মবহির্ভূতভাবে মুনাফা বিতরণের নামে অর্থ উত্তোলন, নিয়োগ ও পদোন্নতিতে গুরুতর অনিয়ম এবং আঞ্চলিক বৈষম্য, চুক্তিভিত্তিক মেয়াদ শেষে পুনর্নিয়োগ ছাড়া এক নির্বাহীকে বেআইনিভাবে দায়িত্বে রাখা এবং তাকে বেতন ও বোনাস প্রদান, কর্মস্থলে উপস্থিত না থেকেও বিল উত্তোলনের অনুমোদন এবং জাকাত-সিএসআর ফান্ড বিতরণে অনিয়মসহ নানা অপকর্ম।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর এই তথ্যগুলো প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। এতে আতঙ্কিত হয়ে গ্রাহকেরা একযোগে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন শুরু করলে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে তীব্র তারল্য সংকট দেখা দেয়।

Discussion about this post