আসাদুজ্জামান রাসেল, রাজশাহী : চলতি রবি মৌসুমের শুরুতেই রাজশাহী জেলাজুড়ে দেখা দিয়েছে তীব্র সার সংকট। বিশেষ করে আলু চাষের জন্য অত্যাবশ্যকীয় টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সার প্রায় পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারি মূল্যে সার না পেয়ে কৃষকরা বাধ্য হয়ে ব্ল্যাকমার্কেট থেকে ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা বেশি দরে সার কিনছেন। অনেকে আবার অতিরিক্ত টাকা দিয়েও সার পাচ্ছেন না। ফলে আলুবীজ রোপণের প্রধান সময় পার হয়ে যাচ্ছে, উৎপাদন খরচ বাড়ছে, লাভের আশা কমে যাচ্ছে। জেলার তানোর, গোদাগাড়ী, পবা, মোহনপুর, পুঠিয়া, দুর্গাপুর, চারঘাট, বাঘা, বাগমারাসহ প্রায় সব উপজেলাতেই একই চিত্র।
রাজশাহী দেশের অন্যতম প্রধান আলু উৎপাদনকারী জেলা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (উঅঊ) তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে জেলায় আলুর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন, যা ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ হবে। এর জন্য প্রয়োজন প্রায় ১৫ হাজার টনের বেশি টিএসপি-ডিএপি সার এবং ১০ হাজার টন এমওপি। কিন্তু নভেম্বর মাসের বরাদ্দ প্রায় শেষ, ডিসেম্বরের বরাদ্দ এখনো পুরোপুরি ছাড় হয়নি। ফলে বাজারে দেখা দিয়েছে কৃত্রিম সংকট। রাজশাহী অঞ্চলিক কৃষি অফিসের হিসাবে, গত মাসে ১৪ হাজার ৩৭৪ টন এমওপি, ২৫ হাজার ৬০০ টন ডিএপি এবং ৯ হাজার ২৮৬ টন টিএসপি বরাদ্দ হয়েছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় এটি অপ্রতুল। এই সংকট শুধু আলু চাষ নয়, পরবর্তী সময়ে বোরো ধান চাষেও প্রভাব ফেলবে বলে কৃষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
বাজারে চলছে সিন্ডিকেটের ছায়া আর তার প্রভাব। পবা উপজেলার রামচন্দ্রপুর বাজারে গত সোমবার সকালে গিয়ে দেখা যায়, ডিলারের দোকানের সামনে শতাধিক কৃষক লাইনে। অনেকে সকাল ৭টা থেকে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু দুপুর ১২টা পর্যন্ত এক বস্তা টিএসপিও পাননি। ডিলার আবুল কালাম জানান, নভেম্বরের বরাদ্দ শেষ। ডিসেম্বরের বরাদ্দ এখনো আসেনি। তিন বস্তা চাইলে এক বস্তা দিতে পারি না। গত তিন দিন তো এক বস্তাও দিতে পারিনি।
অন্যদিকে একই বাজারে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে সার পাওয়া যাচ্ছে, তবে দাম শুনলে গা জ্বলে ওঠার মতো। সরকারি মূল্যে ডিএপি সারের বস্তা (৫০ কেজি) ১০৫০ টাকা। কিন্তু ব্ল্যাকমার্কেটে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায়। টিএসপি সারের সরকারি মূল্য ১ হাজার ৩৫০ টাকা। কিন্তু কৃষকরা কিনছেন ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ১০০ টাকায়। এমওপির সরকারি দাম এক হাজার টাকা, কিন্তু বাজারে ১ হাজার ১৮০ থেকে ১ হাজার ৪৫০ টাকা। কোথাও কোথাও ২ হাজার ২০০ টাকাও উঠেছে। তানোর উপজেলায় একই দৃশ্য এমওপির জন্য কৃষকরা হাহাকার করছেন। একজন চাষি বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই দিয়ে ডিলাররা কারসাজি করছে।’
পুঠিয়ায় সংকট আরও তীব্র। চলতি আমন মৌসুম থেকেই কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে ডিলাররা বস্তাপ্রতি ৫৫০ টাকা গচ্ছিত করছেন। কৃষকদের অভিযোগ, সারের দাম বেশি নেওয়া হলেও বেশির ভাগ ডিলার কোনো রসিদ দিচ্ছেন না। কেউ কেউ রসিদ দিলেও তাতে সরকারি দামই দেখানো হচ্ছে। সার কিনতে গেলে ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা কৃত্রিম সংকটের কথা বললেও বেশি দাম দিলে সহজেই সার পাওয়া যাচ্ছে। অনেক ডিলার দোকানের সরকারি মূল্যতালিকা ঢেকে রেখেছেন।
এদিকে সার সংকটের পাশাপাশি আরেক অভিযোগ উঠেছে, ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা কৃষকদের জোর করে অপ্রয়োজনীয় সার কিনতে বাধ্য করছেন। তানোরের কৃষক হারুন অর রশিদ বলেন, ‘আমার শুধু টিএসপি আর ডিএপি লাগবে। কিন্তু ডিলার বলছে, এক বস্তা টিএসপি নিতে হলে দুই বস্তা ইউরিয়া আর এক বস্তা এমওপি নিতে হবে। আমার ইউরিয়া এখন লাগবে না। তবু বাধ্য হয়ে নিতে হচ্ছে। এতে আমার উৎপাদন খরচ বস্তাপ্রতি আরও ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা বেড়ে যাচ্ছে।’
একই অভিযোগ পবা, গোদাগাড়ী ও মোহনপুরের কৃষকদের। তারা বলছেন, ‘যে সার লাগে সেটা দিচ্ছে না, যেটা লাগে না সেটা গছিয়ে দিচ্ছে।’ জয়পুরহাটের মতো অঞ্চলে সিন্ডিকেট গঠন করে ডিলাররা সার মজুত করে বেশি দামে বিক্রি করছেন, যা রাজশাহীতেও ছড়িয়ে পড়েছে। কৃষকরা বলছেন, ‘এটা সিন্ডিকেটের খেলা। ডিলাররা রাতের বেলা ট্রাক ভরে বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে, তারপর আমরা বেশি দামে কিনতে বাধ্য হচ্ছি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পবার একজন সার ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমরা ডিলারের কাছ থেকে সরকারি দামে পাই না। বাইরে থেকে কিনতে হয়। গতকাল এক ট্রাক ডিএপি এসেছে, বস্তাপ্রতি কিনেছি ১ হাজার ৫৫০ টাকায়। পরিবহন খরচসহ ১ হাজার ৬০০ পড়ে। বিক্রি করছি ১ হাজার ৬৫০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকায়। লাভ খুব বেশি নয়। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আছে, তারা ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে।’ তানোরের আরেক ব্যবসায়ী জানান, কিছু ডিলার নিজেরাই সরকারি বরাদ্দের সার ব্ল্যাক মার্কেটে ছেড়ে দিচ্ছেন।
রাজশাহী অঞ্চলে সারের সংকটের পেছনে আমদানির ঘাটতি এবং বেসরকারি আমদানিতে ভাটা মূল কারণ। রবি মৌসুম শুরু না হতেই ডিএপির চাহিদা বেড়েছে, কিন্তু সরবরাহ চাহিদার তুলনায় কম। ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপির সরবরাহ চাহিদার কাছাকাছি হলেও ডিএপির সংকট সবচেয়ে বেশি। বিদেশি সূত্র থেকে আমদানিকৃত সার যেমন তিউনিসিয়ান টিএসপি ২ হাজার টাকা, মরক্কোর ডিএপি ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা আরও দামি।
দুর্গাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহানা পারভীন লাবনী বলেন, ‘বরাদ্দ অনুযায়ী সারের সংকট নেই। তবে পুকুরে মাছ চাষের জন্য অনেকে সার ব্যবহার করছে। এ কারণে সাময়িক সংকট দেখা দিতে পারে। বেশি দামে কেনার বিষয়ে আমার জানা নেই।’ তবে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, ‘বাস্তবতা হলো ইরি-বোরো মৌসুমের কথা ভেবে অনেক বড় কৃষক ও ব্যবসায়ী এখনই সার মজুত করছেন। আলুর জন্য যে বরাদ্দ, সেটা তারা তুলে রেখে দিচ্ছেন। ফলে আলুচাষিরা সংকটে পড়ছেন। এটা একটা বড় সমস্যা।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া সম্প্রতি রাজশাহী সফরে বলেছেন, ‘দেশে সারের কোনো সংকট নেই। ডিসেম্বর পর্যন্ত যথেষ্ট স্টক আছে।’ তবে তিনি স্বীকার করেছেন, সঠিক ব্যবহারে উৎপাদন ১৫-৪০ শতাংশ বাড়তে পারে। কিন্তু কৃষকরা বলছেন, এসব কথা বাজারের বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না।
অধিকাংশ ডিলার নভেম্বরের বরাদ্দ তুলে নিয়েছেন। কিন্তু বিতরণে অনিয়ম ও মজুতদারির কারণে কৃষকরা পাচ্ছেন না। রাজশাহী অঞ্চলে ডিসেম্বরে আরও ১৫ হাজার ৮৯৭ টন এমওপি, ৩১ হাজার ২৮৮ টন ডিএপি এবং ৯ হাজার ৮১৭ টন টিএসপি বরাদ্দ হবে, কিন্তু এটি চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়।
তানোরের কৃষক শফিউর রহমান জানান, তিনি এবার ১৫ বিঘা জমিতে আলু লাগাবেন। সাধারণত প্রতি বিঘায় তিন বস্তা ডিএপি ও দুই বস্তা টিএসপি লাগে। সরকারি দামে হলে তার খরচ হতো প্রায় ৭৫ হাজার টাকা। কিন্তু বর্তমান বাজারদরে খরচ দাঁড়াবে ১ লাখ ১০ হাজার টাকার ওপর। ‘৩৫ হাজার টাকা বেশি খরচ। আলুর দাম না বাড়লে এবার লোকসান গুনতে হবে।’ আলু চাষে সারের পাশাপাশি বীজ, কীটনাশক ও ভাড়া খরচও বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় সারের দাম ২০-৩০ শতাংশ বেড়েছে।
আলু চাষে সার প্রয়োগের সঠিক পদ্ধতি-রোপণের সময় টিএসপি ও ডিএপি (প্রতি হেক্টর ২৫০ কেজি), পরে এমওপি (১৫০ কেজি) এবং ইউরিয়া (২০০ কেজি)। কিন্তু সংকটে এসব মেনে চলা কঠিন।
কৃষকরা অভিযোগ করছেন, কৃষি অফিসে গিয়ে লাভ নেই। মনিটরিং নেই। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান নেই। ফলে অসাধু ডিলার ও ব্যবসায়ীরা বেপরোয়া। তানোরের কৃষক গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘আমরা জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’ রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নাসির উদ্দিনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল ও খুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
মাটি ও ফসল গবেষণা ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) সম্প্রতি এক আলোচনায় বলেছে, ভারসাম্যপূর্ণ সার প্রয়োগ মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা করবে এবং সংকট মোকাবিলায় সাহায্য করবে। কৃষকদের মাটি পরীক্ষা করে সার ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
আলু চাষের মূল সময় ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এর মধ্যে সার না পেলে রাজশাহীর আলু উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কৃষকরা এখন সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছেনতাৎক্ষণিক মনিটরিং, ব্ল্যাক মার্কেটের বিরুদ্ধে অভিযান, পর্যাপ্ত সারের সরবরাহ এবং ‘খামারি অ্যাপ’-এর মতো টুলসের মাধ্যমে সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। নইলে যে সংকট শুরু হয়েছে, তা কেবল আলুচাষি নয়, পুরো গ্রামীণ অর্থনীতিতেই প্রভাব ফেলবে। সরকারকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে কৃষকরা লাভবান হন।
প্রিন্ট করুন






Discussion about this post