Print Date & Time : 9 August 2025 Saturday 9:50 am

ঋণখেলাপি জাতীয় উন্নয়নের প্রতিবন্ধক 

 শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ লাখ কোটি টাকার বেশি। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা গত অর্থ বছরে এ সময় ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। খেলাপি আদায়ে  আইনের কঠোর প্রয়োগের প্রয়োজন।

দেশের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো খেলাপি ঋণ ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৭ দশমিক ০৯ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৯৪ কোটি টাকা বা ২৬ দশমিক ১৯ শতাংশ। এক বছর আগে, গত বছরের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। সে বিবেচনায় এক বছরে বেড়েছে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৩৬ কোটি টাকা বা ১৫০ দশমিক ৯২ শতাংশ।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সময় দেশে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ১৫ বছরে যা এখন ৫ লাখ কোটি টাকার বেশি। ঋণখেলাপির কারণে দেশের ব্যাংকিং সেক্টর মুখ থুবড়ে পড়ার পথে। তাই এর আশু উত্তরণ জরুরি।

খেলাপি থেকে বাঁচতে অর্থঋণ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়েছেন কমপক্ষে এক হাজার ৭০০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। তবে খেলাপি ঋণ আদায়ে এখনও ৭০ হাজারের বেশি মামলা ঝুলছে আদালতে। এসব মামলার বিপরীতে ব্যাংকগুলোর পাওনা ছাড়িয়েছে ২ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা। আইনজীবীরা বলছেন, স্থগিতাদেশ নেয়ায় এসব ঋণ আদায় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। ফলে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা ঋণ আদায় অসিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এই মামলা গুলোর দীর্ঘ সূত্রিতার কারণে বাড়ছে খেলাপি সংস্কৃতি।

অনিয়ম, দুর্নীতি ও নামে-বেনামে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে এক শ্রেণির সুবিধাভোগী। বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে ব্যাপক অর্থবিত্তের মালিক হলেও, সময় মতো এসব অর্থ পরিশোধ করেননি। উল্টো হয়েছেন খেলাপি। অর্থঋণ আদালতের মামলা থেকে স্থগিতাদেশও নিয়েছেন অনেকে তারপর অনেকেই ছাড়ছেন দেশ। এই বিপুল অঙ্কের টাকা ঋণ খেলাপিরা বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত আড়াই লাখের বেশি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ৭৪৭টি। তবে এসব মামলার বিপরীতে ব্যাংকগুলো আদায় করেছে মাত্র ২৬ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। এখনও মামলা বিচারাধীন আছে ৭০ হাজারের মতো। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, কেউ যাতে সহজেই আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে ঋণ কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে না পারে, সে ব্যাপারে আইনি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তবে বিদ্যমান আইনে তা কতটুকু সম্ভব তা ভেবে দেখার দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নজরদারিতে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনার কেন্দ্রে থাকা এস আলম গ্রুপ-নিয়ন্ত্রিত পাঁচটি ইসলামী ধারার ব্যাংকের দুর্বল অবস্থা সামনে এসেছে। এই পাঁচ ব্যাংকের গড় খেলাপি ঋণের হার প্রায় ৭০ শতাংশ। এই ব্যাংকগুলো হলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল), ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল)।

রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকটির নথিপত্র অনুযায়ী, শীর্ষ-২০ খেলাপির কাছে আটকে আছে ৫ হাজার ৮০ কোটি টাকা। ২০২৪ সালে এসব গ্রাহক থেকে আদায় হয়েছে মাত্র ১২১ কোটি টাকা। এ ছাড়া অবলোপন করা হয়েছে এমন শীর্ষ ২০ গ্রাহকের ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা। বিদায়ী বছরে এসব গ্রাহক থেকে আদায় হয়েছে মাত্র ২ কোটি টাকা। শীর্ষ-২০ খেলাপি গ্রাহকের মধ্যে রয়েছে হলমার্ক গ্রুপের টিঅ্যান্ড ব্রাদার্স ও হল-মার্ক গ্রুপ, রূপসী গ্রুপ, মডার্ন স্টিল, তাইপেই বাংলা ফেব্রিকস, ফেয়ার ট্রেড ফেব্রিকস, রহমান গ্রুপ। অন্য শীর্ষ খেলাপিরা হলো অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, মুন্নু ফেব্রিকস, লীনা গ্রুপ, রতনপুর স্টিল, মাগুরা পেপার মিলস, এপেক্স উইভিং, বিশ্বাস গার্মেন্টস, রেজা জুট, মেঘনা কনডেন্স মিল্ক, সোনালী জুট, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, সুপ্রিম জুট অ্যান্ড নিটেক্স ও শরীফ জুট ট্রেডিং। অবলোপন করা ঋণের মধ্যে হলুমার্ক গ্রুপের ১ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। অন্যরা হলো নিউ রাখী টেক্সটাইল, জাসমীর ভেজিটেবল, ফেরার এক্সপো, আলফা টোব্যাকো, ওয়ান স্পিনিং মিলস, ইম্পিরিয়াল ডাইয়িং, রোকেয়া টেক্সটাইল, সাহিল ফ্যাশন, ইমাম ট্রেডার্স, সুমির সোয়েটার, ইউনিটি নিটওয়্যার, সিদ্দিক ট্রেডার্স, কেপিএফ টেক্সটাইল, মুন নিটওয়্যার, এ আর খান সাইজিং, সাহিল নিটওয়্যার, মাস্ক সোয়েটার, জালালাবাদ ফার্মাসিউটিক্যালস ইত্যাদি। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্টে সরকার পতনের পর ব্যাংকটি খেলাপি ঋণ কিছুটা বেড়েছে। তাতে গত বছর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১৬ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ। ২০২৩ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ১৩ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা বা ১৩ দশমিক ২৩ শতাংশ।

সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো খেলাপি  হয়ে পড়েছে  ২০২৪ সাল শেষে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ রেকর্ড ৬৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকিং খাতে এখন সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ জনতা ব্যাংকে। ব্যাংকের তথ্যে জানা গেছে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের মোট ঋণ এক লাখ ৮০০ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৬৬ দশমিক ৮ শতাংশ বা ৬৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বরে জনতার খেলাপি ছিল ৬০ হাজার ৩৪৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা। বেক্সিমকোয় জনতা ব্যাংকের মোট ঋণের পরিমাণ ২৩ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে শিল্প গ্রুপটির সব ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে। শুধু জনতা ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। তাছাড়া অ্যানন টেক্সের খেলাপি ৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ক্রিসেন্টের খেলাপি ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। থার্মেক্স গ্রুপের খেলাপি ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। সিকদার গ্রুপের ৮৫০ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত জনতা ব্যাংকে বসুন্ধরার মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির অপর শীর্ষ ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন গ্রুপের গত বছর শেষে মোট ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড ঋণের পরিমাণ ছিল সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাত্র কয়েকটি শিল্প গ্রুপের কাছে জনতা ব্যাংক জিম্মি হয়ে পড়ার কারণেই আজ সংকট গভীর হয়েছে। জনতা ব্যাংকে বেক্সিমকোর ঋণ ২০১৫ সালে ২ হাজার ৪৫ কোটি টাকা থেকে বেড়েছে ২০২০ সালে ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা হয়। গত জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এটি ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের প্রায় ৯৫০ শতাংশ। একক ঋণগ্রহীতা হিসেবে তা ২৫ শতাংশের আইনি সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েই চলছে। সদ্য সমাপ্ত ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৮৮৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। খেলাপি ঋণের হার ১৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। সূত্র জানায়, এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের জুন শেষে রূপালী ব্যাংকে খেলাপি ঋণের স্থিতি ছিল ৮ হাজার ৫৭ কোটি ৯১ লাখ টাকা। মার্চ পর্যন্ত  রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ২৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। এটি ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৪১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এটি গত বছরের জুনের তুলনায় ৩৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেশি। অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা রাষ্ট্রীয় এই ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছেন। গত মার্চে ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২৭ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। এটি ব্যাংকটির বকেয়া ঋণের ৬৪ শতাংশ। ৯ মাস আগে তা ছিল ২০ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা। দেশের প্রথম বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক ঋণ অনিয়ম, দুর্বল প্রশাসন ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে লোকসানে পড়ে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২২ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এটি বিতরণ করা মোট ঋণের ৩৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ১৪ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা বা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩৮ শতাংশ। ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ২৫ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। এটি ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৯০ শতাংশ। গত মার্চে আইএফআইসি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ২৫ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। এটি গত বছরের জুনে ছিল তিন হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশের প্রতিটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপী ঋণ পর্যালোচনা করলে একই রকম চিত্র পাওয়া যায়। ব্যাংক গুলোর ঋণের সুদের হার ১২ থেকে ১৩ শতাংশ। সাধারণ ঋণের সুদের হার নির্ধারণ করা হয়,  মুদ্রাস্ফীতি, প্রশাসনিক ব্যয়, ট্যাক্স ভ্যাট ও অন্যান্য খরচ সেই সঙ্গে কু-ঋণ সঞ্চিতির অংশটা যোগ করে। যদি মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশ খেলাপি হয়ে যায়, তাহলে ব্যাংকের ঘূর্ণায়নমান ঋণ তহবিল শেষ হতে বেশি সময় লাগবে না। ব্যাংক ত সাধারণ মানুষের সঞ্চয় আমানত থেকেই এই সব ঋণ বিতরণ করে থাকে। এই রকম খেলাপির প্রভাবে ব্যাংকের সঞ্চয় আমনতও দুরবস্থায় পড়ছে। দেশের অনেক ব্যাংক এখন গ্রাহকের সঞ্চয় করা অর্থ ফেরত দিতে পারছে না।

যাদের কারণে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের এই ঘোর অমানিশা দেখা দিল, তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। এরা সিআইপি ভিআইপি টাইটেলধারী হয়ে আছে। সরকারের এখন আইন করা উচিত, প্রতিটি ঋণ খেলাপির স্থাবর অস্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা, ঋণখেলাপিদের ভোটাধিকার স্থগিত করা, এদের রাষ্ট্রের তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করে সাইন বোর্ড টানিয়ে দেয়া, রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি শহরের প্রধান প্রধান সড়কে। ঋণখেলাপিদের বিশেষ ক্ষমতার বলে গ্রেপ্তার করা।

 

উন্নয়নকর্মী, মুক্ত লেখক

কাদিরগঞ্জ দরিখোরবোনা, রাজশাহী।