নুরুন্নাহার চৌধুরী কলি : একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংকের আমানতকারীরা দুই লাখ টাকা করে ফেরত পাবেন। বাকি টাকা আমানতকারীরা আস্তে আস্তে পাবেন বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে। ইতোমধ্যে পাঁচ ব্যাংকের আমানতকারীদের তালিকা সংগ্রহ শুরু হয়েছে।
পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক একীভূত করে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যাংক গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একীভূত হওয়ার প্রস্তাবিত ব্যাংকগুলো হলোÑ ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যেই আমানতকারীদের সুরক্ষায় একটি বিশেষ পেমেন্ট স্কিম প্রণয়ন করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্যে, একীভূত হতে যাওয়া ব্যাংকগুলোতে বর্তমানে ১ লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকা আমানত রয়েছে। এর বিপরীতে ঋণের পরিমাণ ছাড়িয়েছে ২ লাখ কোটি টাকা। এসব আমানতের মধ্যে ব্যক্তি (রিটেইল) আমানতকারীদের অংশ প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিকল্পনার মূল দিকগুলো হলোÑ ২ লাখ টাকার মধ্যে আমানত: বীমার আওতায় দ্রুত ফেরত দেয়া হবে। ২ লাখ টাকার বেশি আমানত: ধাপে ধাপে ফেরত দেয়া হবে; সময়সীমা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। ফেরতের সময় সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ হারে রিটার্ন থাকতে পারে; তবে বিদ্যমান সব আমানত স্কিম বাতিল করা হবে। একই গ্রাহক যদি একাধিক ব্যাংকে হিসাব রাখেন, সেগুলোকে একটি হিসাব হিসেবে গণনা করা হবে এবং বিমা সীমা সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা থাকবে।
প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের জন্য একটি বিকল্প হিসেবে নগদ ফেরতের বদলে নতুন গঠিত ব্যাংকের শেয়ার বিতরণ করার প্রস্তাব বিবেচনায় আছে। অন্যদিকে ঋণগ্রহীতাদের ক্ষেত্রে কোনো সুযোগ-সুবিধার পরিবর্তন হবে না; কিস্তি-পরিশোধ আগের নিয়মে চলবে।
একীভূত ব্যাংকের কনসোলিডেটেড সম্পদ দাঁড়াবে প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধন হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা, যা ভাগ করা হয়েছেÑ সরকার ২০ হাজার কোটি, ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স ফান্ড ১০ হাজার কোটি, এবং আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা (যেমন- আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি) থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা।
এ উদ্যোগের উদ্দেশ্য তুলে ধরা হচ্ছে- আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা ও ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পরবর্তী ধাপগুলো চূড়ান্ত করার আগে আরও বিস্তারিত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কৌশল ঘোষণা করবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, আমানতকারীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে অনিয়ম ও খেলাপি ঋণের অভিযোগে গ্রাহকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এ কারণে অনেকেই ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে গিয়ে হয়রানির শিকার হন। নতুন এই উদ্যোগ আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষায় একটি অস্থায়ী সমাধান হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এদিকে আমানতকারীরা বলছেন, কেবল ২ লাখ টাকা দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তাদের দাবি, পূর্ণ আমানতের নিশ্চয়তা এবং দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় কয়েকজন গ্রাহক জানান, বছরের পর বছর ধরে সঞ্চিত অর্থ আটকে আছে। এখন অল্প কিছু অর্থ দিলে সাময়িক স্বস্তি মিললেও মূল টাকা ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত তাদের উদ্বেগ কাটবে না।
আমানতকারীদের অর্থ প্রদান করার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আরিফ হোসেন খান শেয়ার বিজকে বলেন, আমানত সুরক্ষা বিমার আওতায় সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা পর্যন্ত আমানত ফেরত দেয়ার সুযোগ বাংলাদেশ ব্যাংকের আছে। যার প্রয়োজন তারা যেন টাকা তুলতে পারেন। একইসঙ্গে অপ্রয়োজনে যাতে কেউ টাকা তুলে অন্য ব্যাংকে না রাখে সেই অনুরোধও করা হয়েছে। একীভূত হতে চলা পাঁচ ব্যাংকের আমানতকারীরা দুই লাখ টাকা ফেরত পারেন। বাকি টাকা আস্তে আস্তে তুলতে পারবেন একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সরকার একীভূতকরণ করতে ৩৫ হাজার কোটি টাকা দেবে। এই টাকা দিয়ে অনেক ব্যয় মেটানো হবে। শুধু আমানত ফেরত দেয়ার জন্য সরকার এই টাকা দিচ্ছে না।
অর্থনীতিবিদরাও মনে করছেন, একীভূতকরণ প্রক্রিয়া সঠিকভাবে সম্পন্ন হলে ব্যাংক খাতের ওপর আস্থা ফিরতে পারে। তবে শুধু কাঠামোগত পরিবর্তন করলেই হবে না, একই সঙ্গে ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। অর্থনীতিবিদদের মতে, আমানতকারীদের আস্থা ফেরানো এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ব্যাংক খাতের সংস্কার প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে এগোবে। একীভূত হওয়ার পর নতুন ব্যাংকটি হবে দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক। এতে মূলধন, সম্পদ এবং আমানতের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আশা, ফলে গ্রাহকরা তাদের আমানত ফেরত পাওয়ার বিষয়ে আশ্বস্ত হবেন।
এদিকে একীভূতকরণ প্রক্রিয়া ঘিরে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর প্রায় ২১ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে বিরাজ করছে চরম অনিশ্চয়তা ও চাকরি হারানোর আশঙ্কা।
জানা গেছে, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন প্রায় ৫ হাজার ৯৯৬ জন। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে কর্মরত রয়েছেন প্রায় ২ হাজার ২০০ জন, আর ইউনিয়ন ব্যাংকে আছেন প্রায় ৫ হাজার ৮০৭ জন, এদিকে এক্সিম ব্যাংকে আছেন প্রায় ৩ হাজার ২০০ জন এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে আছেন প্রায় ৪ হাজার জন। সব মিলিয়ে পাঁচ ব্যাংকের জনবল প্রায় ২১ হাজার।
একীভূত ব্যাংকে এই বিপুল জনবল রক্ষা করা কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা প্রথম থেকেই সংশয় প্রকাশ করে আসছেন।
এ ব্যাংকগুলোর সিংহভাগ শেয়ার চট্টগ্রামের একটি শিল্পগোষ্ঠীর মালিকানাধীন। কিন্তু ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটের কারণে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে পারছে না। পাশাপাশি বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এর কারণে কর্মকর্তাদের চাকরি হারানোর আতঙ্ক আরও বেড়ে গেছে।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলোয় কর্মীদের বেতন দিতে দেরি হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের অনেকেই বেতন না পেয়ে পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। একীভূতকরণ পরবর্তী সময়ে যদি ঢেলে সাজানো হয় কাঠামো, তবে চাকরি হারানোর শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান নূরুল আমীন শেয়ার বিজকে বলেন, এই ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগ আর্থিক সূচক খারাপ হয়ে পড়েছে। এ কারণেই ব্যাংকগুলো একীভূতকরণের উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ক্ষেত্রে একটি ফরেনসিক অডিট করে ব্যাংকগুলোর আর্থিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এই মূল্যায়নে যদি ব্যাংকগুলো ভালো অবস্থা আসে তাহলে একীভূত হতে হবে না। আবার আর্থিক অবস্থা খারাপ হলে তো একীভূত না হয়েও কোনো উপায় থাকবে না।
‘আমরা তো চাই স্বতন্ত্রভাবে ব্যাংক চালাতে। কিন্তু সেটাও তো সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ব্যাংকগুলোর ৯০ শতাংশের বেশি খেলাপি হয়ে পড়েছে,’ যোগ করেন তিনি। তবে সবগুলো ব্যাংক যেহেতু শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক, এগুলো একীভূত করতে পারলে একটি বড় শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক গড়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন নুরুল আমীন।
চাকরি হারানোর প্রসঙ্গে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান বলেন, এটি নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। কর্মকর্তা ছাঁটাইয়ের সুযোগ নেই। প্রত্যেকটি উপজেলায় নতুন করে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের শাখা খোলা হবে। একইসঙ্গে এটি সরকারি মালিকানাধীন হবে। সোনালী ব্যাংকের পর এই ব্যাংকের নেটওয়ার্ক হবে বেশি।
গত কয়েক বছর ধরেই এ ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। আমানতকারীদের আস্থা হারিয়ে ব্যাংকগুলো থেকে আমানত প্রত্যাহারের হার বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার রেগুলেটরি সহায়তা দেয়ার পরও ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা ও খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ২৫ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা।

Discussion about this post