নুরুন্নাহার চৌধুরী কলি : বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংক নিয়ে চলছে গভীর ষড়যন্ত্র। নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে ব্যাংকটিকে দুর্বল করে একীভূতকরণের দিকে নিয়ে যাওয়াই এই ষড়যন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য। ব্যাংকটি নিয়ে চলমান আলোচনা-সমালোচনা বিশ্লেষণ করে এমনটাই বলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে দেশি-বিদেশি একটি চক্র। তৈরি পোশাক শিল্পের লাইফলাইন খ্যাত এক্সিম ব্যাংককে ধ্বংস করতে পারলে গোটা পোশাক খাতই ক্ষতিতে পড়বে। তাতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে বলে চক্রটি উঠে পরে লেগেছে। এ মিশনে যুক্ত হয়ে পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন স্বার্থান্বেষী ওই গোষ্ঠীটি। তারা এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদারের অপকর্মের দায় ব্যাংকটির ঘাড়ে চাপাতে চেষ্টা করছে। শেয়ার বিজের পর্যবেক্ষণ এমনটাই বলছে।
এ নিয়ে এক্সিম ব্যাংক বলছে, দেশের এক সময়ের শক্তিশালী এই ব্যাংক নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা থাকলেও তা ধোপে টিকবে না। নেতিবাচক প্রচারণা মোকাবিলা করতে ব্যাংকটি সামগ্রিক কার্যক্রম আগের থেকে আরও জোরদার করেছে। এতে ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি আরও মজবুত করতে সহায়ক হচ্ছে বলে মনে করছে ব্যাংকটির কর্তৃপক্ষ।
কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিটা কোম্পানির নিজস্ব স^ত্বা রয়েছে। এটা সম্পূর্ণ স্বাধীন একটি সত্ত্বা। কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের কৃতকর্মের জন্য কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কোনো বিধান নেই। তাই এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক সংশ্লেষের জন্য এক্সিম ব্যাংকে বলির পাঁঠা বানানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই।
এদিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কোনো ব্যাংক নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা দেশের অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়। বাংলাদেশ ব্যাংককে এ ব্যাপারে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের গণমাধ্যমকেও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা করতে হবে। তারা মনে করেন, দেশের ছোট একটি ব্যাংকও যদি দুর্বল হয়ে পড়ে, তার নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে দীর্ঘদিন থাকে। এক্সিম ব্যাংক একটি প্রভাবশালী ব্যাংক। ব্যাংকটির কিছু হলে অর্থনীতিতে বড় প্রভাব পড়বে। আর একটি শক্তিশালী ব্যাংককে জোর করে একীভূত করা হলে তা ভবিষ্যতের জন্য একটি মন্দ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, বেসরকারির ব্যাংকগুলোর মধ্যে এখনও বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে এক্সিম ব্যাংক। নেই তারল্য সংকট, নেই নগদ জমা বা বিধিবদ্ধ জমার ঘাটতি। মূলধন ঘাটতিও নেই ব্যাংকটির। বড় অঙ্কের ঋণের বিপরীতে নিয়মানুযায়ী পর্যাপ্ত জামানত রয়েছে।
অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ব্যাংকপাড়া-খ্যাত মতিঝিল এলাকা, পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউসগুলোতে ঘুরে, গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, তাদের অনেকের মধ্যেই এক্সিম ব্যাংক নিয়ে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। টেলিভিশন টক শো-তেও এক্সিম ব্যাংক রুগ্ন ব্যাংক বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ ধরনের নেতিবাচক প্রচারণা ব্যাংকটির নিয়মিত কার্যক্রমকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা।
জানা গেছে, গত এক-দেড় বছর ধরে গোটা বিশেক ব্যাংক কমবেশি তারল্য সংকটে ছিল। তবে সম্প্রতি এক্সিমসহ পাঁচটি ব্যাংক নিয়ে একীভূতকরণের আলোচনা চলছে। তবে একীভূতকরণে রাজি নয় এক্সিম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও এখন একীভূত নিয়ে আলোচনা কিছুটা কমে এসেছে। শেষ পর্যন্ত এক্সিম ব্যাংক হবে কিনা, সেই সংশয়ও কাটেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের করা অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউর (একিউআর) তথ্য মতে, এক্সিম ব্যাংকের ৫২ হাজার ৭৬ কোটি টাকার বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে ২৫ হাজার ১০১ কোটি টাকাই খেলাপি, যা মোট ঋণের ৪৮ দশমিক ২০ শতাংশ। প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ১৫ হাজার ১১৭ কোটি টাকা।
ব্যাংকটির কর্মকর্তারা বলছেন, সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের অপকর্মের কারণে এক্সিম ব্যাংককে নিয়ে এত সমালোচনা হচ্ছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তার অতি দালালিই এখন ব্যাংকটির জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠাতা বা পরিচালকের ভুলে পুরো ব্যাংককে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো অন্যায়।
এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম স্বপন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যাংকটিকে একটি ভালো অবস্থানে নিয়ে আসতে চেষ্টা করেছি। ইতোমধ্যে ব্যাংকটির অধিকাংশ সূচকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিও সাধিত হয়েছে। আমরা মনে করি, ব্যাংকটি স্বতন্ত্রভাবেই চলতে পারবে। এ জন্য আমরা প্রথম থেকেই একীভূতকরণে রাজি ছিলাম না।’
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন নজরুল ইসলাম মজুমদার। এই সময়ে তিনি নিয়মিত বিভিন্ন ইস্যুতে ব্যাংক থেকে চাঁদা তুলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ত্রাণ তহবিলে জমা প্রদানে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতেন। ফলে ব্যাংক খাতের বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পান তিনি। সেই প্রভাব খাটিয়ে ২২টি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ হাজার ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। অর্থ পাচার করে সম্পদ গড়েছেন বিদেশেও। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) একাধিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য ওঠে এসেছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ থেকে নজরুল ইসলাম মজুমদারকে সরিয়ে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০০৭ সাল থেকে ব্যাংকটিতে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন মজুমদার। প্রায় দেড় দশক বিএবি সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ৫ আগস্টের পর বিএবির সভাপতির দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
নজরুল ইসলাম মজুমদার পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠান নাসা গ্রুপেরও চেয়ারম্যান। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নজরুল ইসলাম মজুমদারের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর রাজধানীর গুলশান থেকে নজরুলকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল। এরপর থেকে তিনি কারাগারে আছেন।
জানা গেছে, ২০১৯ ও ২০২০ সালে লন্ডন শহরের ব্যয়বহুল কেনসিংটনে দুটি বাড়ি কেনেন নজরুল ইসলাম। ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৭৯ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড। কোনোরকম মর্টগেজ সুবিধা ছাড়াই নগদ টাকায় এ মূল্য পরিশোধ করেছেন তারা। পরিদর্শনে ২০২০ সালে যুক্তরাজ্যে অর্থ পাচারসহ দেশের আর্থিক খাতে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম সংঘটিত করার প্রমাণ পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিবেদনে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার ও আমদানি-রপ্তানিতে জালিয়াতির মাধ্যমে ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নাসা গ্রুপ ও এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এক ডেপুটি গভর্নর নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ব্যাংক খাত পুনরুদ্ধার কার্যক্রম নির্ভর করছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর। আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচনের একটি আলোচনা ছিল। নতুন সরকার এসে অন্তর্বর্তী সরকারের অধ্যাদেশ অনুমোদন না করলে তখন কি হবে? তাছাড়া একীভূতকরণের ক্ষেত্রে অর্থও লাগবে আবার অ্যাসেট রিকভারি প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলার কথা রয়েছে। সেক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কোনো রূপরেখা এখনও দেখতে পাচ্ছি না। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে কয়টি ব্যাংক একীভূত হবে সে বিষয়ে আগাম কোনো কথা বলার আগে কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। কারণ ব্যাংক খাত খুবই স্পর্শকাতর।’
ব্যাংক কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট রাহাত খলিল বলেন, ‘জনগণ ব্যাংকের ওপর আস্থা রেখে তাদের আমানত জমা রেখেছে। এক ব্যক্তির কারণে কেন আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাও বিবেচনার দাবি রাখে।’

Discussion about this post